প্রতি রোববার কলমের গোসল দিতাম
তখন রোববার ছিল ছুটির দিন। স্কুলে পড়ি। সবে পেনসিলজীবন শেষ করে কলমজীবনে প্রবেশ করেছি। সে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। কেমন একটা বড় বড় ভাব। একটা ঝরনা কলমের (ফাউন্টেন পেন) মালিক আমি। দুই দিন আগেই নতুন কাঠপেনসিলের পেছনের গোলাপি রবারের গন্ধ নাকে লাগতেই আপন আপন লাগত। আমরা তখন রবারই বলতাম। ইরেজার প্রজন্ম এল আরও পরে (বুঝলাম যাহা রবার, তাহাই ইরেজার)!
জীবনের প্রথম কলম পেলাম বাবার কাছ থেকে। নাম ছিল ইয়ুথ। সবুজ রং। হালকা–পাতলা গড়ন। ভেতরে চাপা উত্তেজনা। আর ওরে যত্ন! প্রতি রোববার ছুটির দিনে কলমের গোসল দিতাম। কলমের ক্যাপ থেকে নিব—সব আলাদা করে খুলে বেশ কিছুক্ষণ পানিতে ডুবিয়ে রাখতাম। স্বচ্ছ পানি আস্তে আস্তে নীল হতো। হালকা থেকে গাঢ়। তারপর কালির বদলে পরিষ্কার পানি ভরে ভরে কলমের ভেতরটা খলখল করে ধুয়ে দিতাম। অনেকটা গাড়ির ‘সার্ভিসিং’–এর মতো।
অতঃপর নরম কাপড় দিয়ে মুছে, বাতাসে শুকিয়ে ফুল ট্যাংক কালি ভরতাম। এ এক নস্টালজিক স্মৃতি। তবে এটাও ঠিক, অঘটন ঘটেছে বিস্তর। ঠিকমতো মুখ লাগানো হয়নি, কলমের কালি চুইয়ে নষ্ট হয়েছে ব্যাগে রাখা বইখাতা। এমনকি ব্যাগ চুইয়ে স্কুলড্রেস পর্যন্ত।
বলপেনের যুগে ঝরনা কলমের এই যত্ন বেশির ভাগ কলম ব্যবহারকারী হয়তো চিন্তাই করতে পারে না এখন। লিখতে লিখতে কলমের কালি ফুরালেই সোজা ময়লার ঝুড়িতে নিক্ষেপ! তবে আমার সেই সবুজ ঝরনা কলমের সঙ্গে বিচ্ছেদ বহুকাল আগেই। বলপেন থেকে ইঁদুরের ঘর্ষণ, অতঃপর মুঠোফোনে তর্জনীর মৃদু স্পর্শ। এই তো জীবন। তবে এটা ঠিক, ব্যাগে একটা কলম না থাকলে অস্বস্তি হয় এখনো এবং সেটা অবধারিতভাবেই জেলপেন।
সহকর্মী পল্লব মোহাইমেন প্রথম আলোর শেষ পাতায় কিছুদিন আগে একজন ঝরনা কলম বিক্রেতা (পুরোনো কলমও বিক্রি করেন) ও সারাই কারিগরকে নিয়ে ফিচার করলেন। ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকায় বসেন মহব্বত। হয়তো ঝরনা কলমের প্রতিও আছে তাঁর বাড়তি মহব্বত। পুরোনো কলমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পুরোনো সেই দিনের কথা। আমার ইয়ুথ কলমের গল্প সেভাবেই আবার সামনে চলে এল। আরও কিছুদিন পর হঠাৎ পল্লবের ফোন, ‘আপা, একটা সবুজ রঙের ইয়ুথ পাওয়া গেছে। আনব?’ নিমেষেই চলে গেলাম স্কুলজীবনে। স্মৃতি শুধু বেদনাই জাগায় না, আনন্দও জাগায়। সবুজ ইয়ুথ কলম আবার আমাকে ফিরিয়ে নিল অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের জীবনে। কলম হাতে পেয়ে ফিরে গেলাম ফেলে আসা রোববারগুলোয়। ব্যবহৃত চকের টুকরা দিয়ে বন্ধের দিন সাদা কেডস ধুয়ে রং করা আর কলমের গোসল দেওয়ার স্মৃতি পেয়ে বসল আমাকে। আমি জানি, ‘আমাদের সময় আমরা এই করতাম সেই করতাম’—বুড়োদের এ ধরনের গল্প হয়তো তরুণদের বিরক্ত উদ্রেক করে। মনে করে, আমরা সময়ের জাহির করছি। কিন্তু ছোটবেলায় দেখা জাপানি টিভি ফিল্ম ‘ওসিন’ কিংবা ‘পেপার চেজ’ যেমন আমার মধুর স্মৃতি, এই ঝরনা কলমও তা–ই।
বারবার দেখি, ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে দেখি। আশ্চর্য! ঠিক এই রকম একটা কলমই তো আমার ছিল। কোথায় গেছে সেই কলম? আর কেই–বা ছিল এই কলমের মালিক? এত দিন তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তবু এই সবুজ ‘ইয়ুথ’ আমার অনেক বয়স কমিয়ে দিল। অনেক মানে অ-নে-ক।