বাংলাদেশের প্রথম টাকা ও কয়েনের নকশাকার শিল্পী কে জি মুস্‌তাফা আর নেই

কে জি মুস্‌তাফা (১৯৪৩-২০২৩)ছবি: খালেদ সরকার

বাংলাদেশের প্রথম টাকা ও কয়েনের নকশাকার শিল্পী কে জি মুস্‌তাফা আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ শুক্রবার (৭ জুলাই) ভোর ৩টার দিকে রাজধানীর হলি ফ‍্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ বহু আত্মীয়স্বজন এবং শুভাকাঙ্খী রেখে গেছেন।

ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের সমস‍্যাসহ বার্ধক‍্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন কে জি মুস্‌তাফা। তাঁর পুত্র আসিফ মুস্‌তাফা প্রথম আলোকে জানান, শুক্রবার ভোর ৩টার দিকে হাসপাতালে কর্তব‍্যরত চিকিৎসক কে জি মুস্‌তাফাকে মৃত ঘোষণা করেন। মরহুমের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় আজ বাদ জুমা রাজধানীর পূর্ব রামপুরায় তাঁর নিজ বাসভবনের নিকটস্থ মসজিদে। বাদ আসর মাদারীপুরের গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হয় মা-বাবার কবরের পাশে।

কে জি মুস্‌তাফা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিটসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ স্মারকেরও নকশাকার। ২০১৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কে জি মুস্‌তাফাকে নিয়ে লেখা একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ পাতায়। শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।

বাংলাদেশের প্রথম টাকার নকশাকার

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ১ টাকার ব্যাংকনোট
ছবি: সংগৃহীত

কথা বলতে বলতে বিকেল গড়িয়ে ততক্ষণে সন্ধ্যা। কে জি মুস্​তাফার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তাঁর বাড়িতে বসেই। ঢাকার রামপুরার পূর্ব হাজীপাড়ার এক গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটির নাম ‘চারুনিলয়’। বাড়িটির দোতলায় বসার ঘরে হঠাৎ করেই অন্ধকার যেন জলদস্যুর মতো লাফিয়ে পড়ল। জ্বালাতে হলো ঘরের দ্বিতীয় বাতিটিও। একনাগাড়ে ঘণ্টাখানেক সময় কথা বলে ফেলেছেন কে জি মুস্​তাফা। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর ৭৬ বছরে পা দিয়েছেন; শরীরটাও ইদানীং খুব ভালো নয়। তাই তাঁর বড় ছেলে কাজী মুস্​তাফা মাহমুদ এলেন চা নিয়ে। যোগ দিলেন আলাপে। বললেন, ‘আমি পরিচিতদের বলতাম, আমার বাবা এমন এক শিল্পী, যাঁর শিল্পকর্ম মানুষের পকেটে পকেটে ঘোরে। এমন ভাগ্য খুব কম শিল্পীরই হয়।’

ছেলের কথায় বিনয়ের সঙ্গে আরও কিছুটা যোগ করলেন কে জি মুস্​তাফা, ‘মানুষ আমাকে টাকা বা ডাকটিকিটের ডিজাইনার হিসেবে চেনে, সম্মান করে; ব্যাপারটা মন্দ নয়। তবে আমি মনেপ্রাণে চিত্রশিল্পী। ছেলেবেলায় বন্ধু ও স্কুলের শিক্ষকেরা বলতেন আমি ভালো আঁকি। ১৯৫৯ সালে মাদারীপুর থেকে ম্যাট্রিক (বর্তমান এসএসসি) পাস করার পর মনে হলো, যাই, আর্ট কলেজে গিয়ে দেখি কী হয়। ভাগ্য ভালো, জয়নুল আবেদিন স্যার আমাকে আর্ট কলেজে নিয়ে নিলেন। ভর্তি পরীক্ষায় আমি হয়ে গেলাম প্রথম! দুই বছর পরও আমি ক্লাসে প্রথম স্থানটি ধরে রাখতে পেরেছি। তাই সবাই যখন আশা করছিল আমি ফাইন আর্টসে যাব, তখন গতিপথ বদলে আমি চলে গেলাম কমার্শিয়াল আর্টসে। ফলে প্রায় সারা জীবন বাণিজ্যিক কাজই করেছি। কিন্তু ওই যে বললাম, আমি মনেপ্রাণে চিত্রশিল্পী।’

দেশের ‘পান’–এ

আর্ট কলেজের চৌহদ্দি পেরোতে না পেরোতেই ১৯৬৪ সালে কে জি মুস্​তাফা চলে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। যোগ দিলেন পাকিস্তান সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে। ডাকটিকিট নকশার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, তারপরও ওই কাজ করতে শুরু করলেন নিষ্ঠার সঙ্গে, দ্রুত সবার নজরও কাড়লেন। পশ্চিম পাকিস্তানিরাও ‘নিষ্ঠার’ সঙ্গে রূঢ় আচরণ করতে লাগল।

মুস্​তাফা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন, এটা তাঁর জায়গা নয়। এর মধ্যে ১৯৬৫ সালের এক ঘটনা মনের ওপর ফেলল বড় প্রভাব। তখন ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে। মুস্​তাফা তাঁর আরও দু–তিন বাঙালি বন্ধুকে নিয়ে গেছেন পানের দোকানে। পান কিনে বাসায় নিয়ে আসার পর খেয়াল করলেন, ওই জিনিস আসলে পান নয়। তাই আবার দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী?’ পাকিস্তানি দোকানির জবাব, ‘ইয়ে পাকিস্তানি পান হ্যায়।’ মুস্​তাফা বিস্মিত, ‘পাকিস্তানি পান হ্যায়? পান আগে কোত্থেকে আসত?’ দোকানি জানাল, ‘ও তো বাঙাল সে আতা থা।’

প্রচণ্ড আঘাত পেলেন মুস্​তাফা। ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘তখন গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম, আমি তো আসলে ওদের কাছে পাকিস্তানিও না, আমি বাঙাল। যাদের মধ্যে এ রকম ধারণা, তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী আসলে? ওদের ওখানে আমি কেন কাজ করব! অবশেষে ১৯৬৭ সালে সুযোগ এল চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার। জ্যেষ্ঠ ডিজাইনার হিসেবে যোগ দিলাম এশিয়াটিক অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেডে এবং আমার পোস্টিং হলো পূর্ব পাকিস্তানে। একই সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন অভিনেতা আলী যাকেরও। দেশে ফিরে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম!’

সেই যে পানের বিষয়টি মুস্​তাফার মনে রেখাপাত করল, সেটার প্রতিফলন দেখা গেল ১৯৭২ সালে, তাঁর কাজে। ১০ পয়সার যে ধাতব মুদ্রা তিনি নকশা করলেন, সেটির এক পাশে রাখলেন পানের ছবি। যে পান ‘বাঙাল’দের প্রাণের বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে।

দেশের জন্য নকশা

কে জি মুস্‌তাফার নকশা করা এক টাকার ব্যাংক নোট (১৯৭৩)
ছবি: প্রথম আলো

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সব শুরু হচ্ছে নতুন করে। নতুন দেশে নতুন মুদ্রা দরকার। সরকার হন্যে হয়ে নকশাকার খুঁজছে। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান ডেকে পাঠালেন কে জি মুস্​তাফাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর এ এন হামিদুল্লাহও মুস্​তাফাকে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলেন। ওই দিনই তাঁর ঠিক পাশের কক্ষে জায়গা করে দিয়ে বললেন, ‘আপনি কাজ শুরু করুন।’ জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের পরামর্শে মুস্​তাফা হাত দিলেন ১ টাকার নোট নকশায়। দুটি নকশা করলেন। এভাবে ৫ ও ১০ টাকারও দুটি নকশা শেষ করলেন দ্রুতই। তারপর ১০০ টাকার নোট। প্রতিটি নকশাই পেল ১০০–তে ১০০ নম্বর। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যখন নকশাগুলো নিয়ে যাওয়া হলো, তখন জানতে চাইলেন, ‘এগুলা কি বিলেত থেকে নকশা করায়া আনা হইছে?’ নকশাকারের পরিচয় পেয়ে তো তিনি মহাখুশি। বললেন, ‘ওকে আমার কাছে নিয়া আসলা না ক্যান?’

মুস্​তাফার আফসোস, ‘আমার দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি। তবে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল দারুণ অন্তরঙ্গ।’

কে জি মুস্‌তাফার নকশায় ক্রিকেট বিশ্বকাপের বিশেষ স্মারক মুদ্রা
ছবি: প্রথম আলো

কাগজের টাকার পর ১, ৫, ১০, ২৫ এবং ৫০ পয়সার ধাতব মুদ্রারও নকশা করলেন মুস্​তাফা। প্রতিটি নকশায় ফুটে উঠল দেশ। বঙ্গবন্ধুর ছবি তো থাকলই, সঙ্গে থাকল ধান, নদী, নৌকা, পাট, শাপলা আর বাংলাদেশের গ্রাম এবং মানুষ। একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৭২ সালে ডাক বিভাগের জন্যও নকশা করতে লেগে পড়লেন মুস্​তাফা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিটের নকশা বেরোল তাঁর হাত দিয়ে। কেবল ডাকটিকিট নয়, খাম, পোস্টকার্ড, অ্যারোগ্রামের নকশাও করলেন একে একে। এ পর্যন্ত আড়াই শরও বেশি ডাকটিকিটের নকশা করেছেন। নন–জুডিশিয়াল, কোর্ট ফি, রাজস্ব ডাকটিকিট, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক এবং প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা দলিলের নকশার সংখ্যা যে কত, তা এখন হিসাব করে বের করতে পারেন না নিজেই। এ ছাড়া ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছর পূর্তিতে নকশা করেছেন একাধিক স্মারক রৌপ্যমুদ্রা।

দেশই যাঁর পুরস্কার

বাংলাদেশের চল্লিশ বছর পূর্তিতে স্মারক মুদ্রা। নকশাকার কে জি মুস্‌তাফা
ছবি: প্রথম আলো

ঘরের দেয়ালে টাঙানো নিজের কাজগুলো দেখাচ্ছিলেন কে জি মুস্​তাফা। স্ত্রী, দুই ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনিদের নিয়ে তাঁর সংসার। ছোট ছেলে কাজী আশেক মুস্​তাফা মারা গেছেন ২০১১ সালে। অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী মেয়ে মুনা মুস্​তাফাই শিল্পীর কাজগুলো গুছিয়ে রেখেছিলেন। নয়তো স্বঘোষিত ‘অগোছালো’ এই শিল্পীর কাজের হদিস পাওয়া হয়তো কঠিন হয়ে পড়ত।

কে জি মুস্​তাফা যে কাজ করেছেন, তার তুলনা নেই। বড় কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাননি, সেটা নিয়ে আফসোসও নেই। কারণ হিসেবে বললেন, ‘এই দেশই আমার জন্য পুরস্কার।’