শুধু গাজা, সুদান আর ইউক্রেন নয়; যুদ্ধ হচ্ছে তোমার পকেটেও

২০২১ সালে শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন মারিয়া রেসা। তিনি একজন সাংবাদিক, ফিলিপাইনের অনলাইন সংবাদমাধ্যম র‍্যাপলারের সহপ্রতিষ্ঠাতা। ২৩ মে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছেন এই নোবেল বিজয়ী।

মারিয়া রেসা
ছবি: হার্ভার্ডের ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

নোবেল ভাষণ দেওয়াটা আজকের চেয়ে সহজ ছিল। কারণ, ২০২১ সালের পর পৃথিবীর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। আমরা এখন এমন এক ভয়াবহ বিজ্ঞান কল্পকাহিনির মধ্যে বাস করছি, যেখানে চোখের পলকে বদলে যেতে পারে সব। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আজ তোমাদের তিনটি পরামর্শ দেব।

১. নিজের সেরাটা বেছে নাও

এই সমগ্র পৃথিবীতে একটাই জিনিস আছে, যা তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারো। নিজেকে।

অথচ অনেক সময় আমরা এই নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলি। ভেতরের কঠিন সত্যকে অবজ্ঞা করি, নিজের খারাপ আচরণকেও যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করি। মনে রেখো তোমার ছোট ছোট কর্মকাণ্ডের যোগফলই তোমার চরিত্র। যদি নিজের মূল্যবোধ সম্পর্কে নিশ্চিত না থাকো, তাহলে হয়তো একদিন ঘুম থেকে উঠে ভাববে, আমি তো এই মানুষটা হতে চাইনি। অতএব নিজের সেরাটা বেছে নাও।

নোবেল বিজয়ের পর বক্তৃতায় একটা কথা বলেছিলাম। তথ্যের দুনিয়ায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়া পুরো পৃথিবীটাকে ওলট–পালট করে দিয়েছে। এখন তথ্যের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছোটে মিথ্যা, যা আমাদের ভয় কিংবা রাগ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। বাড়ায় ঘৃণা। এই সবকিছুর নীলনকশা করাই হয়েছে আদতে মুনাফার জন্য।

একটা কথা বারবার বলি। তথ্য ছাড়া তুমি সত্য পাবে না। আর যেখানে সত্য নেই, সেখানে বিশ্বাসও নেই। এই তিনের অনুপস্থিতিতে আমরা কখনোই একই বাস্তবতার অংশীদার হতে পারব না। না পাব আইনের শাসন, না গণতন্ত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধানও আমরা করতে পারব না।

৭ বছর আগে এই পোডিয়ামে দাঁড়িয়েই মার্ক জাকারবার্গ বলেছিলেন, তাঁর জীবনের লক্ষ্য সারা পৃথিবীকে যুক্ত করা। ফেসবুক বলে, ‘দ্রুত এগোও, ভেঙে ফেলো।’ বটে। এটা গণতন্ত্রকে ভেঙে দিয়েছে।

আরও পড়ুন

আমার হাউ টু স্ট্যান্ড আপ টু আ ডিক্টেটর বইতে আমি (ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট) রদ্রিগো দুতার্তে ছাড়াও আরও একজনের কথা বলেছি। তিনি মার্ক জাকারবার্গ। কারণ, তিনি তাঁর সতীর্থ টেক জায়ান্টদের নিয়ে পৃথিবীটা নিয়ন্ত্রণ করছেন।

হার্ভার্ড বলে, তারা ভবিষ্যতের নেতাদের শিক্ষা দেয়। তোমরা, ভবিষ্যৎ নেতারা যদি এখনই গণতন্ত্রের জন্য না লড়ো, তোমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

কীভাবে করবে? এর জের ধরেই আসে আমার দ্বিতীয় পরামর্শ।

২. সংকটকে সুযোগে বদলে দাও

ডিপ ফেইকের এই যুগে এখন আর নিজের চোখ-কানকেও বিশ্বাস করা যায় না। অনলাইনে যার সঙ্গে কথা বলছ, সে আদৌ মানুষ কি না, সে ব্যাপারেও তুমি নিশ্চিত হতে পারবে না।

ইলন মাস্ক টুইটার কেনার পর শুরুতেই ট্রাস্ট অ্যান্ড সেফটি টিমের সবার চাকরি খেয়েছেন। মেটা আর গুগলও প্রচুর কর্মী ছাঁটাই করেছে। একদিকে এ বছর পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ ভোট দিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন সাইটের প্রতি আমাদের আকৃষ্ট করছে। অর্থাৎ তোমার চোখের সামনে ‘খবর’ ধরা দেবে কদাচিৎ।

কীভাবে জানবে, কোনটা সত্যি? যখন তোমার শরীরটাও হ্যাক হয়ে গেছে। যখন অন্যের হাতে তোমার আবেগ-অনুভূতির নিয়ন্ত্রণও চলে গেছে। তথ্যের বদলে অপতথ্যে ছেয়ে গেছে ইন্টারনেট। প্যারিসের মেয়র আন ইদাগো গত বছর এক্স (সাবেক টুইটার) ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘এটা একটা মানুষভর্তি নর্দমা।’

এই যন্ত্রণা থেকে আমাদের রেহাই পেতে হবে। বিশ্বাসের যে প্রকট সংকট তৈরি হয়েছে, এর অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। আমি সব সময় প্রকৃতির শক্তির ওপর আস্থা রেখে এসেছি। কিন্তু প্রকৃতিও আজ কঠিন পরীক্ষায় পড়েছে। যে প্রযুক্তির আমাদের সংযুক্ত করার কথা, সেই প্রযুক্তিই আজ খারাপকে পুরস্কৃত করছে। আমরা যা হতে পারতাম, তা হওয়া থেকে বঞ্চিত করছে।

৩. নত হও, বিশ্বাস গড়ো

অতএব মানবতার ওপর আমাদের বিশ্বাস আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সেটা শুরু হতে পারে সহানুভূতি থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকার একটা শব্দ আমার খুব প্রিয়। উবুন্টু। অর্থাৎ ‘আমরা আছি বলেই আমি আছি।’

এর অর্থ অন্যের ওপর বিশ্বাস রাখার চেয়েও বেশি কিছু। অন্যের জুতায় পা গলানোর চেয়েও বেশি। কিন্তু সত্যিকার উবুন্টু পেতে হলে আমাদের ঢালগুলো নামাতে হবে। এ প্রসঙ্গেই আসে আমার তৃতীয় পরামর্শ: নত হও।

অনেক অর্জনের পর আজকের জায়গায় পৌঁছেছ। ভাবতে পারো নত হওয়া মানে দুর্বলতা প্রকাশ করা। কিন্তু সব সম্পর্কে, সব আলোচনাতেই সামনে এগোতে হলে, কিছু পেতে হলে কাউকে না কাউকে তার ঢাল নামাতেই হয়। ইগো (অহং), রক্ষণাত্মক মনোভাবকে সরিয়ে রাখতে হয়। তখন অন্যরাও অনুসরণ করে।

সেই অবনত মানুষটা নাহয় তুমিই হলে। কারণ, যখন নত হবে, তখনই শক্ত বন্ধন গড়তে পারবে। আস্থা অর্জন করতে পারবে।

সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। তুমি কী করছ, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। ভেবো না যুদ্ধ শুধু গাজা, সুদান আর ইউক্রেনে হচ্ছে। যুদ্ধ হচ্ছে তোমার পকেটেও। আমরা সবাই সত্যের জন্য, বিশুদ্ধতার জন্য লড়ছি। মনে রেখো, ভবিষ্যতের শাসক তোমাকেও ‘জুম ইন’ করতে পারেন, তুমিও হতে পারো লক্ষ্যবস্তু।

যত বড় সুপারস্টারই হও না কেন, যত দিন তুমি একা, তোমার অর্জন হবে অল্পই। কী আমাদের এক করতে পারে, সেটার খোঁজেই আজ একত্র হওয়া দরকার।

জ্বলন্ত পৃথিবীতে তোমাকে আজ বড় প্রয়োজন। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ