দাম বাড়ার কারণে উশুল দেখানো দেনমোহরের সোনা নিয়ে টাকা দিতে চায় শ্বশুরবাড়ির লোকেরা
অধুনার নিয়মিত বিভাগ ‘পাঠকের প্রশ্ন’। এই বিভাগের বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ব্যরিস্টার মিতি সানজানা। দীর্ঘদিন ধরে তিনি পাঠকদের আইনি প্রশ্নের পরামর্শ দিচ্ছেন। পত্রিকায় কলাম লিখে নানা অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে তাঁর। সেই অভিজ্ঞতার কিছু অংশ পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।
প্রশ্ন: বেশ কয়েক বছর আগে আমার বিয়েতে দেনমোহর ধার্য হয় পাঁচ লাখ টাকা। ওই সময়ে পাঁচ ভরি স্বর্ণালংকার দিয়ে চার লাখ টাকা উশুল দেখানো হয় এবং এক লাখ টাকা বাকি রাখা হয়। এখন সোনার দাম বাড়ার কারণে ওই স্বর্ণালংকার তাঁরা (শ্বশুরবাড়ির লোকেরা) আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। ওই স্বর্ণালংকার বিক্রি করে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বাকি টাকা নিজেরা নিয়ে নিতে চাচ্ছেন। এখন কি আমি কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারব? কাবিননামায় চার লাখ টাকা গয়না দিয়ে উশুল হয়েছে উল্লেখ আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: মুসলিম আইনে বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি। মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী দেনমোহর একটি অন্যতম শর্ত। দেনমোহর স্বামী কতৃর্ক স্ত্রীকে পরিশোধযোগ্য একটি আইনগত বাধ্যবাধকতা। কাবিননামা বিয়ের একমাত্র লিখিত প্রামাণ্য দলিল। বিয়েসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় এর প্রয়োজন হয়। কাজেই আইনগতভাবে দেনমোহরের যে টাকার পরিমাণ কাবিননামায় উল্লেখ করা থাকবে, সেই টাকা পরিশোধ করতে একজন স্বামী আইনত বাধ্য। দেনমোহরের যে অংশ বিয়ের সময় পরিশোধ (উশুল) করে দেওয়া হয়, সেটা তাৎক্ষণিক দেনমোহর। কাবিননামার ক্রমিক নম্বর ১৫ কলামে এই বিষয় সম্পর্কে বলা আছে। বাকিটা বিলম্বিত দেনমোহর হিসেবে ধরা হয়।
তাৎক্ষণিক দেনমোহর স্ত্রী চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধ করতে হয়। আর বিলম্বিত দেনমোহর বিয়ের পর যেকোনো সময় পরিশোধ করা যায়। তবে বিবাহবিচ্ছেদের পর দেনমোহর অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়। দেনমোহর একটি আইনি ও ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা, যা সাধারণত নগদ টাকা বা অন্য কোনো অনুমোদিত সম্পদ, যেমন গয়নাগাটি বা সম্পত্তি দিয়ে পরিশোধ করতে হয়।
আপনাকে যেই স্বর্ণালংকার দেওয়া হয়েছে, তা তাঁরা কোনোভাবেই ফেরত চাইতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে তাঁরা কাবিননামার চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। আপনার লেখায় স্পষ্টভাবে জানাননি, কীভাবে তাঁরা আপনার স্বর্ণালংকার নিয়েছেন। তাঁরা যদি জোরপূর্বক তা করেন, সে ক্ষেত্রে আপনি তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যাবস্থা নিতে পারেন।
যদি আপনার কাছ থেকে জোর করে, আপনাকে ভয় দেখিয়ে বা না জানিয়ে আপনার স্বর্ণালংকার নিয়ে থাকেন, তাহলে তা আপনার প্রতি আর্থিক বৈষম্য হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এটাকে দেশের আইনে পারিবারিক সহিংসতা হিসেবে দেখা হয়। পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে, এমন কোনো ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অপর কোনো নারী বা শিশু সদস্যের ওপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বোঝাবে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ, ১৯৭৯ ও শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯–এর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত নারী ও শিশুর সম–অধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ, পারিবারিক সহিংসতা হতে নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ প্রণীত হয়েছে।
একজন শিশু বা নারী, যিনি পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে পরিবারের অপর কোনো সদস্য কর্তৃক পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন বা সহিংসতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তিনি দেশের আইন অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে পারবেন। আপনি এ ক্ষেত্রে আর্থিক বৈষম্যের শিকার। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০–এর অধীন একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নিম্নবর্ণিত প্রতিকার পেতে পারেন।
১. অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ: এ আদেশ নিয়ে আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে। আদালত সন্তুষ্ট হলে প্রতিপক্ষ বা তার প্ররোচনায় পারিবারিক সহিংসতা ঘটলে বা ঘটবার আশঙ্কা থাকলে আদালত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ প্রদান করতে পারবে।
২. সুরক্ষা আদেশ: সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও প্রতিপক্ষকে শুনানির সুযোগ প্রদান করে আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে পারিবারিক সহিংসতা ঘটেছে বা ঘটবার আশঙ্কা আছে, তাহলে সুরক্ষা আদেশ প্রদান করতে পারবেন। আর প্রতিপক্ষকে পারিবারিক সহিংসতামূলক কোনো কাজ সংঘটন, সংঘটনে সহায়তা বা প্ররোচিত করা বা সুরক্ষা আদেশে উল্লেখিত অন্য যেকোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিতে পারবেন।
৩. ক্ষতিপূরণ আদেশ: আইনের ১৬ ধারায় ক্ষতিপূরণের আদেশের কথা বলা হয়েছে।
এ আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য। এই আইনের ৩০ ধারায় শাস্তির বিধান সম্পর্কে বলা আছে। তবে আদালত চাইলে প্রতিপক্ষকে ধারা ৩০-এর অধীন শাস্তি না দিয়ে ৩১ ধারা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কাজে সেবা প্রদানের জন্য আদেশ দিতে পারবেন এবং বিষয়টি তত্ত্বাবধায়নের জন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে দায়িত্ব প্রদান করতে পারবেন।
আপনি চাইলে এসব আইনের অধীন প্রতিকার চাইতে পারবেন। পাশাপাশি দেনমোহর আদায়ের মামলাও করতে পারেন।
বিচ্ছেদের পর স্ত্রী তাঁর অপরিশোধিত মোহরানা পাওয়ার অধিকারী। দেনমোহর যদি অপরিশোধিত থাকে, তাহলে স্বামীকে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। দেনমোহর অপরিশোধিত কি না, তা কাবিননামায় যা লিখিত হয়েছে, তা দ্বারাই নির্ধারিত হয়। এ জন্যই কাবিননামার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আপনার স্বর্ণালংকার বিক্রি করে দেনমহর পরিশোধ করতে পারবে না। আইনত আপনি আপনার স্বর্ণালংকার তো পাবেনই, একই সঙ্গে দেনমোহরের বাকি এক লাখ টাকাও পাবেন।
আশা করি, আপনার প্রশ্নের উত্তরটি পেয়েছেন।
চিঠি পাঠানোর ঠিকানা
পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: [email protected] (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ডাক ঠিকানা : প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA