বালুর ঢিবিতে ২০ দিন

জুনের মাঝামাঝি আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা। কোম্পানীগঞ্জের শিমুলতলা গুচ্ছগ্রামের অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের এক বালুর ঢিবিতে। দুঃসহ কষ্টে সেখানে ২০ দিন কাটিয়েছেন তাঁরা। ঈদের দিন তাঁদের দেখতে গিয়েছিলেন সুমনকুমার দাশ

এই বালুর ঢিবিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বন্যার্ত অনেক মানুষছবি: লেখক

সন্ধ্যার মুখেই আকাশ কালো করে মেঘ জমল। দেখতে দেখতেই শুরু হলো মুষলধারায় বৃষ্টি। সময় যত গড়াল, ততই বাড়তে থাকল বৃষ্টি। শিমুলতলা গুচ্ছগ্রামের পাশের নদীতে ধেয়ে এল পাহাড়ি ঢল। বাড়ির আশপাশে হু হু করে বাড়তে থাকল পানি। দেখতে দেখতে পানি ঢুকল ঘরে—কোথাও হলো গলাপানি, কোথাও ছুঁল চালের টুলি। নিরুপায় হয়ে ঘরের চালে আশ্রয় নিলেন আতঙ্কিত গ্রামবাসী। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? শিশুদের আর্তচিৎকারে বড়দের ভেতরটা খান খান হয়ে যাচ্ছিল। ওদিকে গবাদিপশু ভেসে যাওয়ার ভয়। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে রাতের নিকষ অন্ধকারেই ছুটলেন পুরুষেরা। অনেকে সাঁতার কেটে গেলেন আশ্রয়কেন্দ্রে।

গ্রামের চারপাশে থই থই পানি। অনেকে দেখলেন, পাশের সুউচ্চ বালুর স্তূপটি তখনো ডোবেনি। বিক্রির জন্য বালুগুলো জমিয়ে রাখা হয়েছিল বছর তিনেক আগে। ১৫ জুন সেখানেই আশ্রয় নিলেন শিমুলতলার ৬০টি পরিবারের ২৫০–৩০০ মানুষ। গবাদিপশুরও ঠাঁই হলো।

আরও পড়ুন
বালুর ঢিবিতে অস্থায়ী আবাস
ছবি: লেখক

মাহমুদারা এসেছেন পরদিন

গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মাহমুদা বেগম। বয়স ২৫ বছর। তাঁর গল্পটা একটু অন্য রকম। ১৫ জুন রাতে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর দিনমজুর স্বামী ফরমান আলী খেয়াল করেন ঘরে হাঁটুপানি। এ অবস্থায় কী করবেন? মেঝেতে ইটের ওপর ইট রেখে একটা খাট পাতেন। সেই খাটের ওপর আরেকটা খাট পাতেন। সেখানেই তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নেন।

মধ্যরাতে মাহমুদা-ফরমানরা দেখেন, পানি তাঁদের ওপরের খাটও ছুঁই ছুঁই করছে। ঘরে বুকপানি। দরজা খোলারও উপায় নেই। অজানা শঙ্কা নিয়ে নিরুপায় হয়ে ঘরেই বসে থাকে পুরো পরিবার। কয়েকবার চিৎকার করে সাহায্যও চায় তারা। কিন্তু বৃষ্টি আর প্লাবনের মধ্যে কে কার খোঁজ নেয়।

অবরুদ্ধ অবস্থায় পুরো রাত কাটে। ভোর হলে আবার ডাকাডাকি শুরু করেন মাহমুদা-ফরমানরা। প্রতিবেশীরা খুঁজতে এসে বুঝতে পারেন তাঁরা ঘরে আটকা পড়েছেন। টিনের চাল কেটে বের করে আনা হয় তাঁদের। তাঁরাও আশ্রয় নেন বালুর ঢিবিতে। মাহমুদা বলেন, ‘কী করে যে বাঁচছি, আল্লাই জানেন। টুলি কাইট্টা বার হইয়া বালুর স্টেকে উঠছি।’

আরও পড়ুন
দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছেন ঢিবিতে আশ্রয় নেওয়া মানুষজন
ছবি: লেখক

বালুর ঢিবিতে দিনরাত্রি

কোনোমতে রাতটা পার করতেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু টানা বৃষ্টি আর পানি বাড়তে থাকলে সেখানেই অস্থায়ী আবাস গড়েন তাঁরা। কেউ পলিথিন দিয়ে তাঁবু বানান। কেউ কেউ টিন দিয়ে বানিয়ে ফেলেন ছাপরা। গাদাগাদি করে বসবাস করেন পরিবার নিয়ে।

আশ্রয় তো মিলল, কিন্তু খাওয়াদাওয়া? ৪০ বছর বয়সী মাসুক বলেন, ‘প্রথম দুই দিন অনাহারে ছিলাম। পরে চিড়া-মুড়ি ত্রাণ পাইছি। তা খাইয়া ছিলাম কয়েক দিন। ত্রিপল দিয়া তাঁবু টানাইয়া বালুর স্টেকে গাদাগাদি কইরা কয়েক শ মানুষের সাথে ছিলাম। কী কষ্ট, বুঝাইবার মতো না। খাইবার পানি নাই, বানের পানি অল্প অল্প খাইয়া তেষ্টা মিটাইছি।’

কথা বলতে বলতে চোখের পানি আটকাতে পারেন না মাসুক মিয়া। তিনি জানান, একটা সময় পাথর কোয়ারিতে শ্রমিকের কাজ করতেন। দুই বছর আগে প্যারালাইসিস হয়, তারপর থেকে ভারী কাজ করতে পারছেন না। স্ত্রী খালেদা বেগমই এখন দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান। চার সন্তান তাঁদের। বন্যার পানির তোড়ে তাঁর ঘর ভেসে গেছে। সেই সঙ্গে গেছে ঘরের জিনিসপত্র।

মাসুকের মতোই প্রথম কয়েক দিন দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছেন ঢিবিতে আশ্রয় নেওয়া মানুষজন। মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক, বিদ্যুৎ কিংবা মোমবাতি ছিল না। সন্ধ্যার পর ঘন অন্ধকারে ঢিবিতে ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হতো। বিশুদ্ধ পানির সংকটে বাধ্য হয়ে বন্যার পানি পান করতেন মানুষজন। কেউ কেউ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পান করতেন। ক্ষুধায় কাতর হলেও বহুদিনের চেনা প্রতিবেশীও নিজের সংরক্ষিত খাবার দেননি। অনেকে অভুক্ত ছিলেন। কয়েক দিন পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।

বন্যার পানি সরে যাওয়ায় বাড়ি ফিরেছেন বালুর ঢিবিতে আশ্রয় নেওয়া মানুষেরা
ছবি: লেখক

তাঁরা বাড়ি ফিরেছেন

ঈদের দিন দুপুরে বালুর ঢিবিতে গিয়ে দেখা গেল, কিছু তাঁবু আর টিনের ছাপরা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কোনো মানুষজন নেই। গবাদিপশুর বর্জ্য, খড়কুটো আর নানা ধরনের প্লাস্টিকের বোতল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ঢিবির পার্শ্ববর্তী গুচ্ছগ্রামে গেলে মানুষজনের দেখা মেলে।

গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা জানান, বাড়িঘর থেকে বন্যার পানি সরে যাওয়ায় ৫ জুলাই বাড়ি ফিরেছেন তাঁরা। তবে বাড়ি ফিরলেও টাকার অভাবে অনেকেই বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ কিংবা সংস্কার করতে পারেননি। এরই মধ্যে এসেছে ঈদ। ঢাকার দুটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গ্রামটিতে তিনটি গরু কোরবানি দিয়ে সবার মধ্যে মাংস বিতরণ করা হয়েছে। দুঃসময়েও গ্রামবাসীর মুখে ফুটেছে ঈদের হাসি।