সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় রাখতে বলা হয় সালাদ। কাঁচা সবজির সালাদকেই স্বাস্থ্যকর হিসেবে প্রতিদিন মেনুতে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। সালাদের প্রধান উদ্দেশ্য, শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য–আঁশ বা ফাইবার, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ করা। কিন্তু এই উপকারগুলো নির্ভর করবে কে কীভাবে সালাদ খাচ্ছে, তার ওপর।
সাধারণত সালাদ প্রস্তুত করতে তিন ধাপে খাদ্য উপাদানের সমন্বয় করে সালাদ বানানো হয়। প্রথম ধাপটি হলো বেস, অর্থাৎ সালাদের মূল যে উপাদান। যেমন সবজির সালাদের মূল উপাদান হলো সবজি, আবার ফলের সালাদের মূল উপাদান হলো ফল। দ্বিতীয় ধাপে সালাদকে মুখরোচক করার জন্য দেওয়া হয় ড্রেসিং। সালাদ ক্রিম, মেয়োনেজ ছাড়াও কয়েকটি খাদ্য উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয় ড্রেসিং। তৃতীয় ধাপে সালাদ পরিবেশনের জন্য সালাদের ওপর দেওয়া হয় টপিং। এটা সালাদের ধরনের উপর নির্ভর করে।
সালাদ পৃথিবীতে বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যুগের পরিবর্তনের পাশাপাশি নানা সামাজিক মাধ্যমের কারণে আমাদের দেশে ইদানীং অনেক রকম সালাদের রেসিপি দেখা যায়। অনেকে আবার ভিডিও চিত্র বা রেসিপি দেখে নিজেরাই তৈরি করে থাকেন। তবে সালাদ স্বাস্থ্যকর কি না, সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে এতে ব্যবহৃত খাদ্য উপাদানের ওপর।
ন্যাচারাল সালাদ
এ সালাদ সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। টমেটো, ক্যাপসিকাম, লেটুস, শসা, কাঁচা মরিচ, ব্রকলি, গাজর, যেকোনো সবুজ শাক, মটরশুঁটি, অর্থাৎ যেকোনো সবজি (কাঁচা বা ভাপানো) দিয়ে সাধারণ সালাদ তৈরি করা হয়। ন্যাচারাল বলার কারণ হলো, এতে কৃত্রিম কোনো খাদ্য উপাদান ব্যবহার করা হয় না।
ড্রেসিং হিসেবে সামান্য লবণ, অলিভ অয়েল, শর্ষের তেল, লেবুর রস, গোল মরিচ দিয়ে খুব সাধারণভাবে এ সালাদ তৈরি করা হয়। এ সালাদে শুধু সবজি ব্যবহার করা হয় বলে এতে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল (বিশেষ করে পটাশিয়াম), ফাইবার ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ওজন কমাতে, উচ্চচাপ নিয়ন্ত্রণে, রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে ও প্রতিদিনের সবজির চাহিদা পূরণে এই রেসিপি খুবই উপকারী। তবে যাঁদের হজমে সমস্যা ও যাঁদের কিডনিতে সমস্যা আছে, তাঁদের জন্য এ সালাদ উপযুক্ত নয়।
প্রোটিন সালাদ
এ–জাতীয় সালাদের রেসিপিতে সবজির সঙ্গে মূল উপাদান হিসেবে প্রোটিন বা প্রোটিনজাতীয় উপাদানের ব্যবহার করা হয়। এ–জাতীয় সালাদ থেকে সবজির অন্যান্য পুষ্টির পাশাপাশি প্রোটিন যুক্ত হয়। যার ফলে এ ধরনের সালাদ কেউ চাইলে মিল হিসেবেও দুপুরের খাবার বা রাতের খাবার হিসেবে খেতে পারে। সবজির সঙ্গে ডিম, মাছ, মুরগির মাংস, ছোলার ডাল, বাদাম ইত্যাদি প্রোটিন যুক্ত করে বানানো হয় এ সালাদ।
আবার কিছু কিছু সালাদে ড্রেসিং হিসেবে প্রোটিন ব্যবহার করেও প্রোটিন সালাদ বানানো যায়। যেমন সবজির সঙ্গে টক দই ড্রেসিং ব্যবহার করলে তাতে প্রোটিন যুক্ত হয়। আবার মূল উপাদানে বেশির ভাগ প্রোটিন ও নামমাত্র সবজি ব্যবহার করেও শুধু প্রোটিন সালাদ বানানো যায়। যেমন চিকেন সালাদ, টুনা সালাদ, চিকেন ক্যাশুনাট সালাদ, টক দই ও ছোলার সালাদ, চিংড়ির সালাদ ইত্যাদি। এ–জাতীয় সালাদে ক্যালরি বেশি পাওয়া যায়। তাই যাঁরা স্বাস্থ্যসচেতন, তাঁরাই এ–জাতীয় সালাদ লাঞ্চ বা ডিনার হিসেবে খেয়ে থাকেন।
প্রোটিনের পাশাপাশি এ–জাতীয় সালাদে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম পাওয়া যায়। তাই যাঁরা জিমে যান বা ভারী ব্যায়াম করেন, যাঁদের পেশি গঠনের প্রয়োজন, তাঁদের জন্য এ ধরনের সালাদ খুবই কার্যকর। আবার যাঁদের ওজন কম, যাঁরা প্রসূতি, যাঁদের প্রোটিনের চাহিদা বেশি, যাঁরা ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নেন, তাঁদের জন্য এ–জাতীয় সালাদ খুবই উপকারী। আবার যাঁরা ওজন কমানোর ডায়েটে আছেন, তাঁরাও মিল হিসেবে এ রকম সালাদ খেলে অনেক উপকার পাবেন।
ফ্যাটসমৃদ্ধ সালাদ
সালাদে ফ্যাট থাকা নির্ভর করে ড্রেসিংয়ের ওপর। যেকোনো স্বাস্থ্যকর খাদ্য উপাদানের সঙ্গে ফ্যাটসমৃদ্ধ ড্রেসিংয়ের ব্যবহার পুরো সালাদকে ফ্যাট ও ক্যালরিসমৃদ্ধ করে। যেমন মাখন মেয়োনেজ, বাণিজ্যিক সালাদ ড্রেসিং, ক্রিম, তেল, মার্জারিন, পনির, ক্রিম চিজ ইত্যাদি। সালাদ শব্দটা স্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকায় থাকলেও ফ্যাটসমৃদ্ধ সালাদ সবার জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।
যাঁদের কোলেস্টেরল বেশি, ওজন বেশি, যাঁদের হার্টের বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে; তাদের জন্য এ ধরনের সালাদ আদৌ উপযুক্ত নয়। বরং উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হয়। সালাদে থাকা উপাদান ছাড়াও এ সালাদ সোডিয়ামের মাত্রা বাড়ায়। তাই অতিরিক্ত খেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
কার্বোহাইড্রেট সালাদ
আসলে সবজি সালাদ থেকে হেলদি কার্বোহাইড্রেট পাওয়া গেলেও তা উপকারী। কিন্তু সালাদের মূল উপাদানে সবজি ছাড়াও অন্য সিরিয়াল গ্রুপের কার্বোহাইড্রেট, যেমন পাস্তা, নুডলস, আলু মূল উপাদান হিসেবে থাকে। আবার টপিং হিসেবে ফ্রায়েড ব্রেড, ফ্রাই, নুডলস ফ্রাই ইত্যাদি থাকতে পারে। এ–জাতীয় সালাদে খাদ্য উপাদান সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। তা না হলে ক্যালরি অনেক বেড়ে যায়। মিল হিসেবে এ ধরনের সালাদ ভালো। ওজন বাড়াতে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে, ওজন কমাতে মিল হিসেবে, গর্ভবতী ও প্রসূতির পুষ্টিচাহিদা মেটাতে, বাড়ন্ত বয়সের জন্য এ ধরনের সালাদ অনেক উপকারী।
ফলের সালাদ
মূল উপাদানে ফলের উপস্থিতি বেশি থাকে। সামান্য উপাদান ব্যবহার করেই বানানো যায় ফ্রুটস সালাদ। তবে সালাদ ছাড়াও এ–জাতীয় খাবার ডেজার্ট হিসেবেও কাজ করে। বিভিন্ন ফলের সঙ্গে, ফলের জুস, অলিভ অয়েল, বিভিন্ন মসলা, লবণ, মধু, চিনি, মরিচের গুঁড়া, লেবুর রস ছাড়াও নানা উপাদান যুক্ত করে এ সালাদ বানানো যায়। শরীরকে চনমনে রাখতে, রক্তের ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতে ও মাংসপেশিকে শক্তিশালী করতে এ ধরনের সালাদের জুড়ি নেই।
বাহারি সালাদ পুষ্টিচাহিদা মেটানো ও রসনা তৃপ্তির জন্য অতুলনীয়। কিন্তু যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সালাদে এসেছেন নানা ফিউশন। তবে সেটা না করাই ভালো। তাতে সালাদ শুধু স্বকীয়তাই হারায় না, নষ্ট হয় তার পুষ্টি গুণাগুণ। তাই চিরাচরিত শসা, টমেটো, পেয়াজ, কাঁচা মরিচ আর লেবুর রসের সালাদ বেশির ভাগ সময় মেনুতে রাখতে পারলে ভালো। সুস্থ থাকার জন্য ভালো খাবার প্রাকৃতিকভাবে খাওয়াটাই শ্রেয়।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ, এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকা