অস্ত্রোপচার হলো দেশেই

জাহিদ সাহেব (ছদ্মনাম), কয়লাখনির একজন প্রকৌশলী। একদিন হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যান খনিতেই। পরিশ্রমী মানুষ তিনি, খনির কর্মকাণ্ড আর রক্ষণাবেক্ষণের সব দায়িত্ব তাঁর মাথায়। ক্যারিয়ারে প্রশংসিত ও নিবেদিত। সবাই ভেবেছিলেন অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণেই এই মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া। তবু সহকর্মীরা ধরাধরি করে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। জানা গেল, পরিস্থিতি একটু জটিল, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। পরিবারের সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। স্বজন ও প্রতিবেশীদের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার আশায় চলে গেলেন পার্শ্ববর্তী দেশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে।

চিকিৎসা চলতে থাকল, সেই সঙ্গে রক্তক্ষরণের কারণ অনুসন্ধান। মস্তিষ্কের রক্তনালির এনজিওগ্রাম করে জানা গেল জন্মগতভাবে জাহিদ সাহেবের মস্তিষ্কের রক্তনালির একটি অংশ বেলুনের মতো ফোলা—যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে এনিউরিজম। শুধু তা–ই নয়, পুরো রক্তনালিই জন্মগতভাবে দুর্বল আর আঁকাবাঁকা (ডিসপ্লাস্টিক)। এই ত্রুটিপূর্ণ রক্তনালি থেকেই রক্তক্ষরণ হয়েছে মস্তিষ্কে, আর এই ত্রুটি মেরামত না করতে পারলে রয়েছে আরও মারাত্মক রক্তপাতের ঝুঁকি। এ যাত্রায় রক্ষা পেলেও পরবর্তী সময়ে আবার রক্তক্ষরণ হলে তাঁর প্রাণ সংশয় দেখা দেবে। হয়তো তিনি এমন গভীর কোমায় চলে যাবেন যে আর ফিরে আসবেন না।

অস্ত্রোপচারের ছবিটি প্রতীকী

এ ধরনের সমস্যায় চিকিৎসকেরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করেন, তার নাম এনিউরিজম ক্লিপিং, যা মাথার খুলি কেটে কম খরচেই করা সম্ভব। কিন্তু তাঁর রক্তনালিতে জন্মগত সমস্যা থাকার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না সেই মুহূর্তে। তার জন্য সবচেয়ে ভালো হলো মাথার খুলি না কেটে এন্ডোভাসকুলার পদ্ধতিতে ক্লিপিং করা। এতে ঝুঁকি কম।

চিকিৎসকেরা জানান যে এ পদ্ধতিতে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫ লাখ টাকার মতো দরকার হবে সেখানে। জাহিদ সাহেবের পরিবারের পায়ের নিচে যেন মাটি সরে যায়। এত টাকা তাঁরা সঙ্গে নিয়ে যাননি, যে অবলম্বন ছিল, তা এরই মধ্যে নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষায় প্রায় শেষের পথে। অগত্যা সিদ্ধান্ত নেন, আপাতত দেশেই ফিরে আসবেন, এরপর টাকাপয়সা জোগাড় হলে আবার যাবেন চিকিৎসা সম্পন্ন করতে। বিধি বাম। এরপরই শুরু হলো কোভিড মহামারি। একে একে বন্ধ হলো সব দুয়ার।

সীমান্ত বন্ধ, দেশেও বড় হাসপাতালগুলোতে অস্ত্রোপচার বা প্রসিডিউর সীমিত। একেবারে দিশেহারা অবস্থা। এ সময় এক সুহৃদ পরামর্শ দেন একবার ঢাকার নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পারেন। হয়তো কোনো ব্যবস্থা হতে পারে। জাহিদ সাহেবকে নিয়ে তাঁরা এলেন ঢাকায়। এখানেও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগের চিকিৎসকেরা মত দিলেন আগের মতোই। আর যেহেতু সরকারি হাসপাতাল, সে জন্য এক-তৃতীয়াংশ খরচেই এই ইন্টারভেনশন সম্ভব। তবে এই অস্ত্রোপচার শেষে পরবর্তী সময়ে চোখের জ্যোতি কমে যেতে পারে, সে কথাটিও জানিয়ে রাখেন তাঁরা। জাহিদ সাহেব তখন সচেতন হলেও সেরিবেলার নিউরোলজিক্যাল লক্ষণগুলো আছে। হাঁটতে পারেন না, ভারসাম্য রাখতে পারেন না, হাত কাঁপে, কথাও বলতে সমস্যা হয়। এই উপসর্গগুলো কতখানি উন্নতি হবে বলা মুশকিল। সব বুঝেশুনে হাসপাতালে ভর্তি হলেন জাহিদ সাহেব। অপারেশনের দিন ঘনিয়ে এল।

অ্যান্ডোভাসকুলার স্টেন্ট অ্যাসিসটেড কয়েলিং মস্তিষ্কের ফোলা রক্তনালি বা এনিউরিজম থেকে রক্তপাত বন্ধের সর্বাধুনিক চিকিৎসা। বিশ্বে এই পদ্ধতিতে এনিউরিজমের চিকিৎসা শুরুই হয়েছে ১৯৯১ সাল থেকে। সফলভাবে এই কয়েলিং করতে পারলে রোগটি পুরোপুরি সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা ৮০-৮৫ শতাংশ। পুরোনো পদ্ধতির তুলনায় এতে হাসপাতালে কম সময় থাকতে হয়, রোগী দ্রুত সেরে ওঠেন আর পরবর্তী সময়ে পুনরায় রক্তপাতের আশঙ্কা অনেক কম। পুরো অস্ত্রোপচার শেষ করতে মাত্র দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে আর রোগী এক–দুই দিনের মধ্যেই বাড়ি যেতে পারেন।

জাহিদ সাহেব দ্রুততম সময়ে সেরে উঠলেন। তার হাঁটাচলার ভারসাম্য, কাঁপুনি ইত্যাদিও এখন সেরে গেছে। তিনি আবার তাঁর কাজে পূর্ণোদ্যমে ফিরে গেছেন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি, জাতীয় নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।