একটি জীবন বাঁচাও: জরুরি প্রয়োজনে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রত্যেকের যা জানা উচিত

ফার্স্ট এইড বক্সছবি: খালেদ সরকার

মানবদেহ আঘাত, অসুস্থতা ও ট্রমাতে সংবেদনশীল। আমরা জানি না কখন আমাদের নিজেদের বা আমাদের ভালোবাসার লোকদের বা আমাদের চারপাশের লোকদের ওপর আঘাত আসতে পারে।

প্রাথমিক চিকিৎসা হলো সামান্য বা গুরুতর অসুস্থতা বা আঘাতজনিত যেকোনো ব্যক্তিকে জীবন রক্ষা করতে, অবস্থার অবনতি থেকে বাঁচতে বা পুনরুদ্ধারের জন্য যত্নসহকারে দেওয়া প্রথম বা তাৎক্ষণিক সহায়তা। এটির মধ্যে পেশাদার চিকিৎসাসহায়তা পাওয়ার আগে গুরুতর অবস্থায় প্রাথমিক হস্তক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন: ছোটখাটো অবস্থার চিকিৎসা দেওয়া, প্লাস্টার বা ব্যান্ডেজ করা, একজন আহত রোগীর রক্তপাত বন্ধ করার উপায় প্রয়োগ করে জীবন বাঁচানো, পাশাপাশি পেশাদার চিকিৎসাসহায়তা পাওয়ার আগে কার্ডিওপলমোনারি পুনর্বাসন (সিপিআর) সম্পাদন করা। প্রাথমিক চিকিৎসা সাধারণত এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেউ করে থাকেন। সুতরাং গুরুতর পরিস্থিতিতে যত্ন নেওয়ার জন্য, খারাপ থেকে আরও খারাপ হওয়া বা চিকিৎসাসহায়তা না আসা অবধি সুস্থ্ রাখার জন্য প্রত্যেকের কিছুটা প্রাথমিক জ্ঞান থাকা ভালো।

প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় শনিবার ‘বিশ্ব ফার্স্ট এইড ডে’ বা প্রাথমিক চিকিৎসা দিবস পালন করা হয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংগঠন, বিশেষ করে রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এদিন বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কীভাবে প্রতিদিন এবং সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রাথমিক চিকিৎসা জীবন বাঁচাতে পারে, সে সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে দিনটি উদ্‌যাপিত হয়।

প্রাথমিক চিকিৎসা সবার কাছে সুলভ হওয়া উচিত। একজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রয়োগের প্রাথমিক বিষয়গুলো অবশ্যই জানতে হবে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আমরা জানি, অনিয়ন্ত্রিত রক্তপাতের ট্রমা প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রথম কারণ। প্রাথমিক চিকিৎসার অভাবে অনিয়ন্ত্রিত রক্তপাতের কারণে কেউ যেন মারা না যায়, তাই সুপারিশ করি, সমস্ত নাগরিক রক্তপাত বন্ধ করতে শিখুন।

প্রাথমিক চিকিৎসার অগ্রাধিকারগুলো নির্ধারণের নীতি

এটিএলএসের মতো প্রোটোকলগুলো নির্ধারণের নীতি এবং সেই পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে যদি পৃথক পদক্ষেপ সঠিকভাবে সম্পাদন করা যায়, তবে জরুরি মুহূর্তে বেশি জীবন রক্ষা করা সম্ভব। এই প্রোটোকলের মূল পয়েন্টগুলো সহজে মনে রাখার উপায় হলো ‘এবিসিডিই’ (ABCDE)- এটি মনে রাখা।

এবিসিডিই হলো,

এ: অ্যাশিউর ইয়োর সেফটি

বি: ব্রিদিং

সি: সার্কুলেশন অ্যান্ড ব্লিডিং

ডি: ডিসঅ্যাবিলিটি

ই: এক্সপোজার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল কন্ট্রোল

এ: অ্যাশিউর ইয়োর সেফটি:

আপনার নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। কাউকে সহায়তা করতে গিয়ে নিজে অসুস্থ্য হয়ে পরা যাবে না।

  • সতর্কতা কল করুন বা কাউকে ৯১১ নম্বরে কল করতে বলুন কিংবা কাছাকাছি থাকা কোনো ডাক্তার ডাকার চেষ্টা করুন।

  • শ্বাসনালি পরিষ্কার করুন।

বি: ব্রিদিং:

যদি শ্বাস এবং হৃদ্‌যন্ত্র বন্ধ হয়ে যায় (কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট) তাহলে সিপিআর করুন। অর্থাৎ বুকে হাত দিয়া ধীরে ধীরে চাপ দিন এতে শ্বাস স্বাভাবিক হতে পারে।

সি: সার্কুলেশন অ্যান্ড ব্লিডিং:

রক্ত সঞ্চালন ও রক্তক্ষরণ হলে সরাসরি চাপ প্রয়োগ করে রক্তপাত বন্ধ করুন। যদি হাত বা পা থেকে রক্তপাত হয় এবং টর্নিকোয়েট পাওয়া যায়, তবে রক্তপাতের জায়গার ওপরে সেটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে যাতে রক্তপাত বন্ধ হয়।

ডি: ডিসঅ্যাবিলিটি:

খেয়াল করতে হবে, স্বায়ুবিক কারণে ব্যক্তিটি অজ্ঞান হয়ে গেছে কি না। জ্ঞান হারালে তার জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

ই: এক্সপোজার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল কন্ট্রোল:

আহত বা অসুস্থ্য ব্যক্তির পরিধেয় বস্ত্র ঢিলেঢালা করে দিতে হবে। যদি কম্বল বা মোটা কাপড় পাওয়া যায় তাহলে সেটি দিয়ে আহত বা অসুস্থ্য ব্যক্তিকে মুড়ে দিতে হবে যাতে তার শরীরের তাপমাত্রা কমে না যায়।

প্রাথমিক চিকিৎসার যন্ত্রপাতি

প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাগ বা বাক্সের ওপর সাধারণত সবুজ পটভূমিতে একটি সাদা ক্রস দিয়ে চিহ্নিত করা থাকে
ছবি: উইকিপিডিয়া

প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ বা বাক্স পাওয়া যায়। সাধারণত এগুলি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বাক্স হয়ে থাকে। প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাগ বা বাক্সের ওপর সাধারণত সবুজ পটভূমিতে একটি সাদা ক্রস দিয়ে চিহ্নিত করা থাকে।

ফার্স্ট এইড কিটের সম্ভাব্য জিনিসপত্রগুলো হলো তথ্য লিফলেট, মাঝারি ও বড় স্টেরাইল ড্রেসিংস, ব্যান্ডেজগুলো- গজ রোলার ব্যান্ডেজ/ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ/আঠালো ব্যান্ডেজ/ত্রিভুজাকার ব্যান্ডেজ, টর্নিকোয়েট, সুরক্ষা পিন, জীবাণুমুক্ত ভেজা ওয়াইপ, মাইক্রোপারাস টেপ, নাইট্রাইল গ্লাভস, ফেসশিল্ড, ফয়েল কম্বল, পোড়া পোশাক, পোশাকের কাঁচি, কনফার্মিং ব্যান্ডেজ, ফিঙ্গার ড্রেসিং, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, কাঁচি, ট্যুইজার, সরঞ্জামগুলো স্যানিটাইজিংয়ের জন্য অ্যালকোহল প্যাড, কয়েকটি জরুরি ওষুধ ইত্যাদি।

বিশ্ব প্রাথমিক চিকিৎসা দিবসের উদ্দেশ্য

বিশ্ব প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তা দিবসের প্রথম লক্ষ্য আহত ব্যক্তির জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। সাধারণ প্রাথমিক চিকিৎসা দক্ষতা এবং সেগুলো ব্যবহারের আত্মবিশ্বাস জীবন বাঁচাতে পারে। প্রত্যেকে যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত হয়, তবে জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

বিশ্ব প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তা দিবসের উদ্দেশ্য হলো, আহত ব্যক্তির জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, প্রাথমিক চিকিৎসা করে আহত ব্যক্তির অবস্থা উন্নত করা ও সংক্রমণ এড়ানোর চেষ্টা করা এবং বড় কোনো দুর্ঘটনায় বা জরুরি মুহূর্তে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া

দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, প্রাথমিক চিকিৎসা করে আহত ব্যক্তির অবস্থা উন্নত করা এবং সংক্রমণ এড়ানোর চেষ্টা করা। জীবন বাঁচাতে প্রাথমিক চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে আহত ব্যক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং জ্ঞান প্রয়োজন।

তৃতীয় লক্ষ্যটি হলো, বড় কোনো দুর্ঘটনায় বা জরুরি মুহূর্তে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত কাজ করার দক্ষতা জীবন বাঁচাতে এবং আঘাতের প্রভাব কমাতে সহায়তা করতে পারে।

প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কেন গুরুত্বপূর্ণ

সুরক্ষা বাড়ায়:

প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণের ভিত্তি হলো ‘প্রতিরোধ’। ‘দুঃখিত’ হওয়ার চেয়ে নিরাপদ থাকা সব সময় ভালো। প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞানটি মানুষের মধ্যে সুরক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের বোধকে উৎসাহ দেয়, তারা আশপাশে যে পরিবেশে বাস করে, তাদের আরও সচেতন ও নিরাপদ হতে উৎসাহ দেয়।

ব্যথা উপশম করতে সহায়তা করে:

কিছু আঘাতের জন্য আইস প্যাক লাগানো বা দ্রুত ঘষার মতো খুব সাধারণ সমাধান প্রয়োজন। কিছু কিছু সময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এ ক্ষেত্রে, প্রাথমিক চিকিৎসা কোর্সে প্রশিক্ষিত একজনের সহায়তাই যথেষ্ঠ। প্রাথমিক চিকিৎসার সহজ পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে ব্যথা কমাতে সহায়তা করা যায় এবং কমপক্ষে অস্থায়ীভাবে ব্যথা উপশম করা যেতে পারে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা শিক্ষার সূচনা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। এতে শিশুরা প্রাথমিক চিকিৎসার প্রাথমিক দিকগুলো শিখতে পারবে জীবনের শুরুতেই। প্রাথমিক চিকিৎসা শিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের প্রাথমিক চিকিৎসা করতে এবং মানুষকে সহায়তা করার প্রবণতা বিকাশে অনুপ্রাণিত করা উচিত।

জীবন বাঁচাতে সহায়তা করে:

প্রাথমিক চিকিৎসা প্রয়োগে আশপাশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে দেখে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে এবং দুর্ঘটনা কবলিত মানুষের জীবন বাঁচানো যেতে পারে। দুর্ঘটনা কবলিত অবস্থায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি ট্রমাজনিত পরিস্থিতিতে বেশি উপকার করতে পারেন।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধা দেয়:

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি জানেন কীভাবে পরিস্থিতিকে খারাপ থেকে আরও খারাপ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যায়। পেশাগত সহায়তা না আসা পর্যন্ত তারা অস্থায়ী চিকিৎসা সরবরাহ করবে, যা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অবস্থার অবনতি থেকে রক্ষা করবে।

জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসহায়তার প্রয়োজনে অনেক লোক মারা যাওয়ার কারণ প্রাথমিক চিকিৎসার অভাব। প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান আপনার নিজের জন্য যেমন তেমনি আপনার আশপাশের মানুষের জন্যও মূল্যবান। সহায়তা না আসা পর্যন্ত দুর্ঘটনা বা জরুরি পরিস্থিতিতে পড়লে আহত ব্যক্তিদের সহায়তা করতে আপনাকে সক্ষম করে তুলবে প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা শিক্ষার সূচনা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। এতে শিশুরা প্রাথমিক চিকিৎসার প্রাথমিক দিকগুলো শিখতে পারবে জীবনের শুরুতেই। প্রাথমিক চিকিৎসা শিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের প্রাথমিক চিকিৎসা করতে এবং মানুষকে সহায়তা করার প্রবণতা বিকাশে অনুপ্রাণিত করা উচিত।

লেখক: শিশু ইউরোলজিস্ট ও হেলথ ইকোনমিস্ট, অধ্যাপক, শিশু সার্জারি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ