একসঙ্গে একাধিক সন্তান কেন হয়

প্রীতি, রীতি ও সিঁথি—এই তিন বোনের জন্ম একসঙ্গেপ্রথম আলো

সন্তান আসার খবরে সব দম্পতিই আনন্দে অধীর হয়ে ওঠেন। তবে যখন জানতে পারেন গর্ভে সন্তান একটি নয়, যমজ কিংবা তারও বেশি—তখন একটু ঘাবড়েও যান। একাধিক সন্তান গর্ভে ধারণ, প্রসব ও লালন-পালনের মতো বাস্তবতার কথা ভেবে এমন চিন্তিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই তখন মাথায় ঘুরতে থাকে নানা জটিলতার কথা।

এটি গর্ভধারণকালীন একটি জটিলতাই বলা যায়। কিন্তু একাধিক সন্তান একসঙ্গে কেন হয়, হলে ভয় আছে কি না বা সামালই–বা দেওয়ার উপায় কী?

গত ১৭ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জের এক গৃহবধূ একসঙ্গে এই চার কন্যাসন্তানের জন্ম দেন

একাধিক সন্তান গর্ভধারণ

একই সঙ্গে একাধিক সন্তান গর্ভধারণকে মাল্টিপল প্রেগন্যান্সি বলে। এটি স্বাভাবিক বা সুপরিচিত ঘটনা নয়। সাধারণত যমজ, ক্ষেত্রবিশেষে তিনটি (ট্রিপলেট), চারটি (কোয়াড্রুপলেট) কিংবা আরও বেশি সন্তান ধারণের ঘটনাও হতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ২৫০ গর্ভধারণের মধ্যে ১টির যমজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে ট্রিপলেট বা ৩টা হওয়ার হার প্রতি ১০ হাজার গর্ভধারণের ১টিতে, ৪ জন হওয়ার হার আরও কম, প্রতি ৭ লাখে ১ জনের। তবে বর্তমানে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার মাধ্যমে সন্তান নেওয়ার হার বেড়ে যাওয়ার কারণে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এমনটা কেন হয়

স্বাভাবিকভাবে একটি শুক্রাণু ও একটি ডিম্বাণুর নিষেকের ফলে একটি ভ্রূণ তৈরি হয় এবং সেটিই জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত হয়ে মানবসন্তান হিসেবে ভূমিষ্ঠ হয়। কখনো কখনো দুটি বা তিনটি ডিম্বাণু একই মাসিকচক্রের সময়ে নিষিক্ত হলে দু-তিনটি বাচ্চা একই সঙ্গে হতে পারে। বিশ্বে সর্বাধিক আটটি শিশু একই সঙ্গে ভূমিষ্ঠ হওয়ার রেকর্ড আছে। এই বহু সন্তান হতে পারে বহু ডিম্বাণু থেকে, আবার হতে পারে একটিই ভ্রূণ বিভক্ত হওয়ার মাধ্যমে। তবে বহু ডিম্বাণু থেকে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

এই বহু ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার ঘটনা খুব বেশি নয়। তবে ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যত্বের চিকিৎসার সময়ে ডিম্বাণু তৈরির জন্য ওষুধ প্রয়োগের ফলে বহু ডিম্বাণু তৈরি হয়ে থাকে এবং তাঁদেরই একাধিক সন্তান গর্ভধারণের ঝুঁকি বেশি। আবার টেস্টটিউব চিকিৎসার সময়ে যতগুলো ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের জন্য দেওয়া হয়, ততগুলো সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পরিবারে একাধিক সন্তান জন্ম দেওয়ার ইতিহাস থাকতে পারে, যেমন কেউ নিজে যদি একজন যমজ সন্তান হয়ে থাকেন বা মাতৃকুলে ফ্র্যাটারনাল টুইন জন্ম হওয়ার ইতিহাস আছে, তবে তাঁরও যমজ সন্তান জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা আছে।

একসঙ্গে বহু ডিম্বাণু থেকে যমজ শিশু জন্ম হলে তাকে ডাইজাইগোটিক যমজ বলে, অর্থাৎ তারা একসঙ্গে জন্ম নিলেও ভিন্ন ভিন্ন জাইগোট বা ভিন্ন ভিন্ন ভ্রূণ থেকে এসেছে। কিন্তু একটি ভ্রূণ বিভক্ত হয়ে যমজ হলে তাকে মনোজাইগোটিক যমজ বলে। একটি ভ্রূণই ভাগ হয়ে তাদের জন্ম হয়েছে বলে তাদের জিনগত গঠন অভিন্ন, তাই চেহারা থেকে শুরু করে তাদের স্বভাব-চরিত্র সবকিছু একই রকম হয়ে থাকে।

একাধিক সন্তান গর্ভধারণে মা ও গর্ভস্থ শিশুর বিভিন্ন রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই এটিকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

তিন ভাই আলাপ, আমল ও আকিক মায়ের কোলে আসে একই সময়ে

অন্তঃসত্ত্বা মায়ের ঝুঁকি

গর্ভকালীন মায়ের অতিরিক্ত বমি হতে পারে। রক্তে আয়রনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়াজনিত জটিলতাও তৈরি হয়। আবার ভ্রূণের থলিতে অতিরিক্ত পানি জমা, যাকে পলিহাইড্রামনিওস বলে। এর ফলে এবং একের অধিক বাচ্চা থাকার ফলে পেট অনেক বড় হয়ে যায়। মায়ের চলাফেরা ও ঘুমাতে কষ্ট হয়। ওপরের দিকে চাপ প্রয়োগের ফলে শ্বাসকষ্টও হয়। জরায়ুর ভেতরে বাচ্চার অস্বাভাবিক অবস্থান, অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে মাথা নিচের দিকে না থেকে পশ্চাৎদেশে থাকা কিংবা আড়াআড়িভাবে থাকতে পারে। গর্ভকালীন রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। একাধিক বাচ্চা, অতিরিক্ত পানির জন্য জরায়ুর ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাওয়ার ফলে সময়ের আগেই পানির থলি ফেটে যায় বা পানি ভেঙে যায় এবং প্রসবও হয়ে যায়।

প্রসবের সময় ও পরে

আগে আগে পানি ভেঙে যাওয়া এবং বাচ্চার নাড়ি বের হয়ে যাওয়া। বিশেষ করে বাচ্চা আড়াআড়ি থাকলে এবং পানির থলে ফেটে গেলে নাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত মাকে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়। প্রলম্বিত হতে পারে প্রসবের সময়। স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব না হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণের আশঙ্কা বেড়ে যায়।

প্রসবের পর জরায়ু অনেক বড় হয়ে যাওয়ার ফলে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে দেরি হয়। প্রদাহের আশঙ্কা বেড়ে যায়। বিভিন্ন জটিলতার কারণে একাধিক বাচ্চার জন্য পর্যাপ্ত বুকের দুধ না পাওয়ার ঘটনা ঘটে।

নবজাতকের জটিলতা

গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে। সময়ের আগে প্রসব হওয়ার ফলে কম ওজন নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয় নবজাতক। জন্মগত ত্রুটি থাকতে পারে। জরায়ুর ভেতরে মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রি–একলাম্পসিয়া বা রক্তক্ষরণের কারণে বাচ্চার জন্মের পরপর শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এক বাচ্চার রক্ত অন্য বাচ্চার শরীরে চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এর ফলে দুটো বাচ্চাই নানা জটিলতায় ভোগে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ নবজাতক মৃত্যুহার লক্ষ করা যায়। জোড়া লাগানো যমজ বেশি হওয়ার কারণ, এখানে ভ্রূণ দেরি করে বিভক্ত হয় বলে সম্পূর্ণ বিভক্ত হতে পারে না। তাই পরবর্তী সময়ে জটিল সার্জারির মাধ্যমে আলাদা করতে হয়।

মায়ের করণীয়

আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে একাধিক শিশুর অবস্থান গর্ভকালের প্রথম দিকেই এখন শনাক্ত করা যায়। যদি একাধিক সন্তানের বিষয়টি জানতে পারেন, তবে আতঙ্কিত না হয়ে মাকে অবশ্যই গর্ভকালীন পরিচর্যায় থাকতে হবে।

পুষ্টি: একটি শিশু ঠিকমতো বেড়ে ওঠার জন্য প্রতিটি মায়ের আগের চেয়ে অন্তত ৩০০ ক্যালরি পরিমাণ বেশি পুষ্টি দরকার হয়। তাহলে যমজ বাচ্চার জন্য আরও ৩০০ ক্যালরি অতিরিক্ত খেতে হবে। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে হবে।

বিশ্রাম: একটি বাচ্চার জন্য যে বিশ্রাম, তার চেয়ে বেশি বিশ্রাম নিতে হবে মাকে। ২৪ সপ্তাহ পার হওয়ার পর সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকা উচিত সময়ের আগে প্রসব ঠেকানোর জন্য।

সাপ্লিমেন্ট: আয়রন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফলিক অ্যাসিড—সবকিছুর মাত্রা বাড়িয়ে খেতে হবে। এ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

চিকিৎসাকেন্দ্রে যাওয়া: নিয়মিত প্রতিটি প্রসবপূর্ব বা অ্যান্টিনাটাল ভিজিটে যেতে হবে। সময়মতো জটিলতা নিরূপণ এবং সমাধানের জন্য একাধিক সন্তানের ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের বেশিও যেতে হতে পারে। বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি নিরূপণ এবং অন্যান্য জটিলতা নিরূপণের জন্য প্রয়োজনে একের অধিকবার সময়মতো আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে হবে।

প্রসবের সময়ে তো অবশ্যই, যেকোনো জরুরি সময়েও হাসপাতালে যেতে হবে। এ ধরনের গর্ভাবস্থায় বাড়িতে প্রসবের কোনো সুযোগ নেই। যে হাসপাতালে মা ও শিশুর চিকিৎসা ও পরিচর্যার সুবন্দোবস্ত আছে, তেমন হাসপাতালেই যেতে হবে।

একাধিক সন্তান ধারণ এড়ানো

প্রাকৃতিকভাবে মাল্টিপল প্রেগন্যান্সি ঘটে থাকলে তা এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই বা প্রতিরোধব্যবস্থাও নেই। তবে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার কারণে সন্তান ধারণ হয়ে থাকলে, তার প্রতিরোধ করা যায়। সে ক্ষেত্রে কখনো অধিক ডিম্বাণু সুগঠিত হলে সেই মাসে গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকা। টেস্টটিউবের বেলায় অনেক ভ্রূণের পরিবর্তে একটি ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে।

তবে প্রাকৃতিকভাবেই হোক বা চিকিৎসার ফলেই হোক দুইয়ের অধিক হলে সেটার একটি চিকিৎসা আছে। অর্থাৎ তিনটি বা চারটি হলে গর্ভধারণের প্রথম দিকেই সেখান থেকে একটি বা দুটিকে জরায়ুর ভেতরেই নষ্ট করে দেওয়া হয়। মা ও সন্তানের মঙ্গলের জন্য এটি নৈতিকতার জায়গা থেকে তো বটেই, চিকিৎসাশাস্ত্রেও একটি গ্রহণযোগ্য চিকিৎসা হিসেবেও বিবেচিত।

অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম: ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ও চিফ কনসালট্যান্ট ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা