কুষ্ঠ সেবায় মাঠে আছে অনেক প্রতিষ্ঠান

কুষ্ঠরোগ নিয়ে কুসংস্কার অনেকটা দূর হয়েছে। রোগের প্রকোপও কমেছে। রোগ নির্মূলে সম্পদ বাড়ানোর পাশাপাশি কাজে সমন্বয় জরুরি।

বিশ্ব থেকে কুষ্ঠরোগ উচ্ছেদের জন্য ১৯৯১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এর একটিতে বলা হয়েছিল, ২০০০ সালের মধ্যে চিকিৎসাধীন কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যায় ১ জনের নিচে নামাতে হবে। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছিল। বাংলাদেশের এই অর্জনে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল কিছু বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে কয়েকটি খ্রিষ্টান মিশনারি প্রতিষ্ঠান। এমন একটি প্রতিষ্ঠান এক শ বছরের বেশি সময় ধরে এই কাজ করে যাচ্ছে।

দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন দেশে কুষ্ঠরোগের প্রকোপ অনেক বেশি ছিল। যদিও রোগতাত্ত্বিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে বড় বড় শহরে কুষ্ঠরোগীদের ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত থাকতে দেখা যেত। সেই দৃশ্য অনেক আগেই দূর হয়েছে। কুষ্ঠ আক্রান্ত হয়ে হাতে-পায়ের মাংস পচে খসে পড়ছে বা বিকলাঙ্গ মানুষ এখন আর দেখা যায় না।

কুষ্ঠ প্রাচীনতম রোগগুলোর একটি। এ রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে গভীর কুসংস্কার ছিল। বলা হতো, পাপ করলে কুষ্ঠরোগ হয়। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অভিশপ্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজে জায়গা হতো না, তারা অবজ্ঞা ও ঘৃণার সম্মুখীন হতো। এদের চিকিৎসা ও সেবা সহজ ছিল না।

এখন এই রোগের কারণ ও চিকিৎসা জানা। দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে বহু বছর ধরে কুষ্ঠরোগ নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির এ দেশীয় পরিচালক শলোমন সুমন হালদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে এখন কুষ্ঠরোগী শনাক্তের জোরদার কর্মসূচি আছে। রোগের ব্যাপারে জনসচেতনতা বেড়েছে। কুসংস্কার অনেকটাই দূর হয়েছে। রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। আছে পুনর্বাসন কর্মসূচিও।’

সেবা দিচ্ছে ১০০ বছরের বেশি

ক্রিশ্চিয়ান মিশনারিরা রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনাতে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১৩ সালে। ওই বছরেই ওই হাসপাতালে একজন কুষ্ঠরোগী চিকিৎসার জন্য আসেন। তখন থেকেই এই হাসপাতালে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়। এটি এখন খ্রিস্টিয়ান কুষ্ঠ চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এই কেন্দ্রটি ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন কুষ্ঠ হাসপাতাল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্লিনিক তৈরি করে চট্টগ্রাম শহর, পটিয়া, ফেনী, মালুমঘাট, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায় কুষ্ঠরোগীর সেবা বিস্তৃত করে।

এদিকে ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন সিস্টার টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর শালবনে জলছত্র এলাকায় কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসায় একটি হাসপাতাল গড়ে তোলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সাল থেকে এই হাসপাতালটি পরিচালনা করছে ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন।

স্বাধীনতার পরপর উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় কুষ্ঠরোগের প্রকোপ বেশি ছিল। ১৯৭৭ সালে ডেনিশ বাংলাদেশ লেপ্রসি মিশন নীলফামারীতে কুষ্ঠ সেবা কার্যক্রম শুরু করে। এতে যুক্ত হয় ডেনিশ সানতাল মিশনসহ ডেনমার্কের কিছু দাতা সংস্থা।

ওই সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এটা উপলব্ধি করেন যে হাসপাতালকেন্দ্রিক চিকিৎসা বা সেবা কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব কমাতে পারবে না। দরকার সামগ্রিক ও সমন্বিত কর্মসূচি।

জাতীয় কার্যক্রম সারা দেশে

স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে ১৯৬৫ সালে সরকারিভাবে নীলফামারী, সিলেট ও মহাখালীর তিনটি হাসপাতালে কুষ্ঠরোগ চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এরপর তা থানা পর্যায়ে (বর্তমানে উপজেলা) সম্প্রসারণ করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৯৯৩ সালে জাতীয় কুষ্ঠ নির্মূল কর্মসূচি শুরু করে। বর্তমানে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর প্রোগ্রামের আওতায় যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগের জন্য একটি পৃথক বিষয়ভিত্তিক কর্মসূচি (অপারেশনাল প্ল্যান) রয়েছে। কর্মসূচিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা ও আশু চিকিৎসার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কর্মসূচিতে কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্যান্য চাহিদা, যেমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা মেটানোসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

দেশে এখন কুষ্ঠরোগী শনাক্তের জোরদার কর্মসূচি রয়েছে। রোগের ব্যাপারে জনসচেতনতা বেড়েছে। রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। আছে পুনর্বাসন কর্মসূচিও।
শলোমন সুমন হালদার, এ দেশীয় পরিচালক, দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ

বর্তমানে দেশের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। সরকারের এই কর্মসূচিকে সহায়তা করছে ৮টি বেসরকারি সংস্থা—দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, লেপ্রা বাংলাদেশ, ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, হিড বাংলাদেশ, আরডিআরএস, ধানজুড়ি লেপ্রসি সেন্টার, স্যালভেশন আর্মি ও পিমে সিস্টার্স। এরা কুসংস্কার দূর করা ও সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যশিক্ষা, সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসায় সহায়তা করে আসছে। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) কুষ্ঠ নির্মূলে নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে কারিগরি সহায়তা দেয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, জাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে কুষ্ঠরোগের প্রকোপ কমেছে। গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি বছরে ১০ থেকে ১১ হাজার কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হতে দেখা গেছে। আর ২০২০ সালে শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৭২৪ জন। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে, ২০৩০ সালের পর দেশে আর কোনো নতুন কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হবে না। সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, কুষ্ঠরোগী শনাক্ত শূন্য করতে হলে জনবল ও সম্পদ বাড়ানোর পাশাপাশি কাজে সমন্বয় বাড়াতে হবে।