নারীরা কি তালাক দিতে পারেন?

পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা

মিতি সানজানা
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন: ২০১৪ সালে জোরপূর্বক আমার বিয়ে হয়েছিল। তবে কোথায় ও কোন কাজির মাধ্যমে এ বিয়ে হয়েছে জানি না। এমনকি আমার বাবাও জানেন না। মা ও খালারা বিয়ের সাক্ষী ছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা করেছি কিন্তু তাঁরা আমাকে জানান না। ২০১৬ সালে আমি নিজ থেকে তালাক নোটিশ (ডিভোর্স লেটার) পাঠাই স্বামীর কাছে। কারণ, বিয়ের দিনেই আমি যে বাপের বাড়ি চলে এসেছি, তারপর থেকে স্বামীর সঙ্গে দু–একবার দেখা হওয়া ছাড়া ছয় বছরে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। আমার স্বামী সেই তালাকের কাগজ গ্রহণ করেননি। জানিয়ে দেন, কোনো কাবিননামা আমাকে দেওয়া হবে না। আরও বলেন, মেয়েরা তালাক দিতে পারে না। এত কিছু বললেও আমার সঙ্গে আবার তিনি সংসারও করতে চান না। এদিকে আমি নতুন বিয়ের চেষ্টা করলেই তিনি নিজের বউ দাবি করে সম্বন্ধ ভেঙে দেন। ঘনিষ্ঠ একজনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, চলতি বছর তিনি আবার দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাকে অবশ্য কিছু জানাননি। আমাকে মুক্তিও দিচ্ছেন না, আবার গ্রহণও করছেন না। এখন আমার জিজ্ঞাস্য, কীভাবে আমার বিয়ের কাবিননামা পেতে পারি? আমার যে ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণও আমি চাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর: বিয়ের ক্ষেত্রে কাবিননামা একটি প্রামাণ্য দলিল। বর ও কনের সব তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রার বা কাজি বিবাহ নিবন্ধন বই পূরণ করেন। পূরণ করার পর বর ও কনে বিবাহ নিবন্ধন বইয়ে স্বাক্ষর করেন। তারপর রেজিস্ট্রার বা কাজি তাঁদের কাবিননামা সংগ্রহের একটি রসিদ দেন। আপনার যদি বিয়ের বছর, মাস, দিন, তারিখ সঠিকভাবে মনে থাকে, তাহলে কাজি সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই ওঠানো যাবে। তবে আপনি যেহেতু কোন কাজি অফিসে বিয়ে হয়েছে তা মনে করতে পারছেন না, তাই যেখানে বিয়ে পড়ানো হয়েছে, তার আশপাশে সব কাজি অফিসে আপনাকে খোঁজ নিতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে বা ওয়ার্ডে সরকার নিয়োজিত একজন করে কাজি আছেন। বিয়ে নিবন্ধনের সময় কাজি যে রসিদ দেন, সেই রসিদ সংগ্রহ করে রাখতে হয়। কারণ, কাবিননামা ওঠানোর সময় এই রসিদ দেখালে কাবিননামা তোলার কাজটি সহজ হয়। রসিদ দেখাতে না পারলে প্রতি পাতায় তল্লাশি করতে হয়। প্রতি পাতার জন্য কাজি অফিসে ফি দিতে হয়।

এবার আপনাকে জানাই, আইনে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার স্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামটিতে যদি আপনাকে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে, তাহলে আপনি সরাসরি তাঁকে তালাক দিতে পারেন। আর ১৮ নম্বর কলামে যদি কোনো ক্ষমতা না দেওয়া থাকে, তাহলে আদালতে যেতে হয়। স্ত্রীর তালাকের ক্ষমতা না থাকলে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাকের ডিক্রি নিতে হয়।

তালাক দেওয়ার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে যে তালাক দিতে চাইলে তাঁকে যেকোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর, অন্য পক্ষ যে এলাকায় বসবাস করছেন, সে এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, সিটি করপোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে। সেই সঙ্গে তালাক গ্রহীতাকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তালাকের নোটিশটি কত সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। আইনে বলা আছে তখনই, পরবর্তী সময়ে বা যথাশিগগির সম্ভব। নোটিশ পাঠানোর কাজটি ডাকযোগেও হতে পারে, আবার সরাসরিও হতে পারে। ডাকযোগে রেজিস্ট্রি করে এডি (অ্যাকনলেজমেন্ট ডিউ) সহযোগে পাঠালে ভালো হয়।

চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে যে তারিখে নোটিশ পৌঁছাবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন পর বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক কার্যকর হবে। এ নোটিশ পাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে সালিসি পরিষদ গঠন করতে হবে এবং সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিসের কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে।

আপনি লিখেছেন, আপনি ‘ডিভোর্স লেটার’ পাঠিয়েছেন। কিন্তু আপনার স্বামী তা গ্রহণ করেননি। আপনি যদি উপরোক্ত পদ্ধতিতে তালাক দিয়ে থাকেন, তাহলে ৯০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তালাক কার্যকর হওয়ার কথা। তিনি নোটিশ গ্রহণ করলেন কি না, তার সঙ্গে তালাক কার্যকর হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। নোটিশ দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিসের কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে।

যে পক্ষই তালাক দিক না কেন, তালাক কার্যকরের পর যে কাজির মাধ্যমে তালাকটির নোটিশ সম্পন্ন করা হয়েছে, সে কাজি অফিসে নিবন্ধন করাতে হবে। তালাক নিবন্ধন করা আইনত বাধ্যতামূলক। আগের তালাক সঠিকভাবে আইন মেনে দেওয়া না হলে কার্যকর হবে না। সে ক্ষেত্রে আপনি একজন ভালো আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে আইনানুগভাবে তালাক দিতে পারেন। আইনসংগতভাবে তালাক দিলে দ্বিতীয় বিয়ে করতে কোনো বাধা নেই। তবে আইন মেনে তালাক না দিয়ে আবার বিয়ে করা যাবে না। এতে আপনাকে নানা ধরনের আইনি জটিলতায় পড়তে হবে।

পাঠকের প্রশ্ন, বিশেষজ্ঞের উত্তর

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।

ই–মেইল ঠিকানা: [email protected]

(সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ডাক ঠিকানা

প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন

২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA