কোলোরেক্টাল ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়

বিশ্বব্যাপী মরণব্যাধিগুলোর মধ্যে ক্যানসার অন্যতম। বাংলাদেশেও এটি মৃত্যুহারের জন্য দায়ী রোগগুলোর তালিকায় রয়েছে। তাই ক্যানসার যাতে প্রাথমিক পর্যায়েই প্রতিরোধ করা যায়, সে জন্য এর উপসর্গ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখতে হবে।
তবে আশার কথা হলো প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করলে জটিলতা এড়ানো যায়। এর মধ্যে কিছু রয়েছে, যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, আবার কিছু রয়েছে, যেগুলো আমরা জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিবর্তন করতে পারি। এর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। আর নিয়মমাফিক চলাফেরার মাধ্যমে ক্যানসার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

ডা. লুবাইনা হকের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেনডা. ভাস্কর চক্রবর্তী (ডানে) ও ডা. রুখসানা রব্বানী (বাঁয়ে)

তাই সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসকেএফ অনকোলজি নিবেদিত এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ পর্বে অতিথি হিসেবে যোগ দেন ডা. ভাস্কর চক্রবর্তী, এমবিবিএস, এফসিপিএস (রেডিওথেরাপি), কনসালট্যান্ট অনকোলজি, আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল, উত্তরা, ঢাকা এবং ডা. রুখসানা রব্বানী, সহকারী অধ্যাপক, রেডিওথেরাপি ও অনকোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

এ পর্বের আলোচনার বিষয় ছিল ‘কোলোরেক্টাল ক্যানসার’। অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে সম্প্রচারিত হয়। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন ডা. লুবাইনা হক।

ডা. রুখসানা রব্বানী বলেন, আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে কোলোরেক্টাল ক্যানসার হলো বিশ্বের চতুর্থ ক্যানসার। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশে কোলন ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৭০০-এর চেয়েও বেশি এবং রেক্টাল ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫০০। এক বছরেই এতো রোগী আক্রান্ত হচ্ছে এবং এতে মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বেশি। প্রায় ১ হাজার ৮০০ রোগী কোলন ক্যানসারে এবং প্রায় ১ হাজার ৫০০ রোগী রেক্টাল ক্যানসারে মারা গেছে এক বছরে। এটি সাধারণত অ্যাডভান্সড স্টেজে ডায়াগনোসিস হওয়া ক্যানসার এবং সারা বিশ্বে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে এর আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি।

ডা. রুখসানা রব্বানী

ডা. রুখসানা রব্বানী আরও বলেন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে কোনো একটি কারণকে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে, যেগুলো এ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে কিছু জিনগত এবং কিছু পরিবেশগত কারণ রয়েছে। পরিবেশগত কারণে পুরুষেরা কোলোরেক্টাল ক্যানসারে তুলনামূলকভাবে বেশি আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোতে, বিশেষ করে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষ এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।

আমাদের দেশে এর চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত এবং এখানে বেশির ভাগ রোগীই ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী। এমনকি খুব অল্প বয়সী এবং শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। এর পেছনে জীবনযাত্রার ধরন অনেকটাই দায়ী। আমাদের খাদ্যাভ্যাস, ওবেসিটি বা স্থূলতা, রেড মিট বা প্রসেসড মিট, ফাস্ট ফুড, প্যাকেজড বা প্রসেসড ফুড বেশি খাওয়া ইত্যাদি কারণ রয়েছে। এ ছাড়া যারা শাকসবজি, ফলমূল কম খেয়ে থাকে, তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তা ছাড়া ধূমপান ও মদ্যপান কোলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সাধারণত ৫টি অভ্যাস যেমন; শরীরের ওজন বাড়তে না দেওয়া, নিয়মিত শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহারের মাধ্যমে এ রোগের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যায়।

ডা. ভাস্কর চক্রবর্তী বলেন, আমাদের দেশে ও বিশ্বে কোলোরেক্টাল ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব অনেক বাড়ছে। আগে বলা হতো, কোলোরেক্টাল ক্যানসার বৃদ্ধদের, বিশেষ করে ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে যাঁদের বয়স, তাঁদের হয়ে থাকে। বর্তমানে অনেক অল্পবয়সী, এমনকি শিশুরাও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি ক্যানসারের ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিশ্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রিভেন্ট ক্যানসার ফাউন্ডেশন নামে যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে একটি ছিল কোলোরেক্টাল ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য মার্চ মাসকে নির্ধারণ করা। তাই মার্চ মাসকে কোলোরেক্টাল ক্যানসার সচেতনতার মাস হিসেবে পালন করা হয়।

ডা. ভাস্কর চক্রবর্তী

আবার কোনো কারণে কেউ পেটে কিংবা তলপেটে রেডিয়েশন পেয়ে থাকলে পরবর্তী সময়ে তার আবার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রায় ২০ শতাংশের বেশি রোগী পারিবারিক কারণে আক্রান্ত হয়ে থাকে। বিভিন্ন জিনের ত্রুটির কারণে এ–জাতীয় ক্যানসার হয়ে থাকে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন আলসারের সমস্যায় ভুগলে কোলন ক্যানসার বা রেক্টাল ক্যানসারে আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডা. ভাস্কর চক্রবর্তী আরও বলেন, দুটি ক্যানসার—কোলন ক্যানসার ও রেক্টাল ক্যানসারের উপসর্গও দুধরনের হয়ে থাকে। তবে কিছু সাধারণ উপসর্গ রয়েছে, যা দুটি ক্যানসারের ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়। সাধারণত মলের সঙ্গে রক্ত আসা, পেটে ব্যথা অনুভব করা, পেটে যেকোনো ধরনের চাকা তৈরি হওয়া, শরীরের ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া, ক্ষুধামান্দ্য, বমিভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য বা একটানা পাতলা পায়খানা হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ নিয়ে সাধারণত রোগীরা আসে। তাই উপসর্গ দেখামাত্রই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।