খাবার, পানি, ওষুধের সঙ্গে বানভাসি নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দিচ্ছে ‘মেহমানখানা’

‘শুকনা রুটি-কলা আর গেলা যায় না। সবাই পাউরুটি, মুড়ি, চিড়া, দেয়। আপনারা এত বড় বড় হাঁড়ি আনছেন, আপনারা কি ভাত দেবেন?’
‘আমরা খিচুড়ি দেব।’
‘তা হোক, ভাতের দানা তো! আহা রে, কত দিন পর ভাতের দানা পেটে পড়ব! আল্লাহ আপনাগো বালা করুক।’

ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে মেহমানখানা
ছবি: সংগৃহীত

মেহমানখানার এক স্বেচ্ছাসেবক আর সিলেটের জকিগঞ্জের সাহায্যপ্রত্যাশী বন্যার্ত এক অসহায় মানুষের কথোপকথন ছিল এ রকম। করোনাকাল থেকে লিজা আসমা আক্তারের নেতৃত্বে চলছে মেহমানখানা। মেহমানখানার উদ্যোগে বন্যার শুরু থেকেই চলছে ত্রাণ বিতরণ। নৌকা, কলার ভেলায় করে বন্যায় ডুবে যাওয়া প্রত্যন্ত গ্রামের ঘরে ঘরে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়েছে মেহমানখানা ও জকিগঞ্জের সেচ্ছাসেবকেরা।

স্বেচ্ছাসেবকেরা যোগ দিয়েছেন নৌবাহিনীর সঙ্গে
ছবি: সংগৃহীত

সিলেটের জকিগঞ্জে থাকতেই লিজা দেখেন, সেখানকার নারীদের অনেকেরই একটিমাত্র শুকনা পোশাক। সেটিও আবার পিরিয়ডের রক্তে লাল। সে রকমই এক নারী লিজাকে বলেছিলেন, ‘এক বেলা না খেয়ে থাকা যায়। কিন্তু এ রকম করে কতক্ষণ থাকা যায়? শরমে খিদার কথা ভুইল্যা যাই।’ সে সময় তাঁদের পাশে দাঁড়ায় কনফিডেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। মেহমানখানাকে তারা এক হাজার স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করে। এর পর থেকে মেহমানখানাকে নিয়মিত স্যানিটারি ন্যাপকিন দিচ্ছে তারা। ন্যাপকিন ব্যবহারের সুবিধার্থে আরেকজন দিয়েছেন অন্তর্বাস।

‘কনফিডেন্স’ সরবরাহ করেছে স্যানিটারি ন্যাপকিন
ছবি: সংগৃহীত

সিলেট থেকে দুই দিনের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন মেহমানখানার সদস্যরা। সেই দুদিনও কেটেছে ত্রাণ সংগ্রহের কাজে। তারপরই তাঁরা ছুটে যান সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে। কেননা, সিলেটের পানি কমছিল আর সুনামগঞ্জে বাড়ছিল। লিজার সঙ্গে যখন ফোনে কথা হলো, তখন তিনি দুর্গাপুর গ্রামে। কথা বলতে বলতেই চলছিল ত্রাণ কার্যক্রম। প্রতিদিন এক হাজার মানুষকে ত্রাণ দেন লিজা ও তাঁর দল। সেই ত্রাণের ভেতর থাকে রান্না করা খাবার (খিচুড়ি), শুকনা খাবার (চিড়া, মুড়ি, খেজুর, বিস্কুট), খাবার পানি, স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, স্যানিটারি ন্যাপকিন আর প্রয়োজনীয় ওষুধ। ১২ দিন হলো সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ দিচ্ছেন তাঁরা।

স্কুলপ্রাঙ্গনে চলছে রান্না
ছবি: সংগৃহীত

মেহমানখানার হাতে হাত ধরে কাজ করছে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল। তারা নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করছে সেফটি হেলমেট ও লাইফ জ্যাকেট। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী। যেহেতু মেহমানখানার নিজস্ব নৌযান নেই, তাই তারা সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর নৌযান ব্যবহার করছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলছে ত্রাণ কার্যক্রম। সেনাবাহিনী আর নৌবাহিনীও মেহমানখানাকে অনেক ত্রাণসহায়তা দিয়েছে। এ ছাড়া মেহমানখানার সঙ্গে আছে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন বাংলাদেশ–অস্ট্রেলিয়া ডিজাস্টার রিলিফ কমিটি এবং কানাডার হোপ বাংলাদেশ। চিকিৎসকদের একটি সংগঠন দিয়েছে প্রয়োজনীয় ওষুধ। তা ছাড়া, অসংখ্য মানুষ নাম–পরিচয় গোপন রেখে কাপড়চোপড়, অর্থ, চাল, তেল, পানি দিয়ে সাহায্য করছে মেহমানখানাকে। এভাবেই বানভাসি, পানিবন্দী মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন জানা–অজানা বহু মানুষ।

বন্যার্ত মানুষেরা ভালো নেই
ছবি: সংগৃহীত

মেহমানখানার উদ্যোক্তা লিজা বলেন, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সহায়তায় জামালগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প বানিয়ে থাকছেন তাঁরা। প্রতিদিন সেখানে রান্না হয়। প্যাকেটে করে ত্রাণ হিসেবে সরবরাহ করার পাশাপাশি প্রতিদিন সেখানে খায় প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ। ‘আর কত দিন থাকবেন?’ জানতে চাইলে লিজা বললেন, ‘এখানে যে কী পরিমাণ ত্রাণ দরকার, এর কোনো সীমা–পরিসীমা নেই। মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ। কোরবানির ঈদ আমরা এখানেই করব। ক্রমেই পানি কমছে। অনেক মসজিদ, মন্দির, টয়লেট, ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। যে সাহায্য আসছে, তা দিয়ে এসব মেরামতের কাজ করব। এবার সেমাই–চিনিতে নয়, বরং বন্যায় ভাঙা ভবন মেরামতের মধ্য দিয়েই কাটবে আমাদের ঈদ।’

চলছে খিচুরি বিতরণ
ছবি: সংগৃহীত

লিজার মাধ্যমেই কথা হলো সেখানে উপস্থিত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শফিকুর রহমানের সঙ্গে। নৌবাহিনীর এই সদস্য বলেন, ‘এখানে অনেক গ্রাম হাওরের ভেতর ছোট ছোট দ্বীপের মতো। সেসব গ্রামের সঙ্গে বাকি বিশ্বের এই মুহূর্তে কোনো যোগাযোগ নেই। আমরা এখানে ৩৩ জনের একটা টিম কাজ করছি। আমরা আগে গ্রামগুলো চিহ্নিত করে গ্রাম, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এভাবে একটা ম্যাপ বানিয়ে রেড জোন চিহ্নিত করছি। এসব গ্রামে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ যায়নি। আমাদের যেহেতু নৌযান আছে, তাই এসব গ্রামে সবার আগে ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।’