গর্ভাবস্থা ও ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস মানে রক্তে শর্করার আধিক্য। নারীদের বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস হয়—গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা জেসটেশনাল ডায়াবেটিস। এ ছাড়াও যাঁরা আগে থেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাঁদেরও সন্তানধারণের সময় সতর্ক থাকতে হবে।

অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কিছু হরমোনের প্রভাবে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল থেকে উৎপন্ন কর্টিসল, হিউম্যান প্লাসেন্টাল ল্যাকটোজেন, প্রজেস্টেরন, প্রোল্যাকটিন, এস্ট্রাডিওল ইত্যাদি হরমোন রক্তের ইনসুলিনকে তার কাজ করতে বাধা দেয় এবং এর ফলে ইনসুলিন রক্তের গ্লুকোজকে শরীরের বিভিন্ন কোষে সঠিক পরিমাণে স্থানান্তরিত করতে পারে না। অর্থাৎ রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। যদি গর্ভাবস্থাতেই প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, তবে তাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (জেসটেশনাল ডায়াবেটিস মেলিটাস বা জিডিএম) বলা হয়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে মা ও শিশু দুজনেরই ঝুঁকি অনেক। তাই ঝুঁকি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে ডায়াবেটিস নির্ণয় এবং এর নিয়ন্ত্রণ।

যাঁদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে, তাঁরা সন্তান নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেবেন। মুখে খাবার ওষুধ পরিবর্তন করে ইনসুলিন গ্রহণ করবেন আর রক্তে শর্করা আগে থেকে সুনিয়ন্ত্রণে এনে তবে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করবেন।

কিন্তু বেশির ভাগ আক্রান্ত নারীর সন্তান নেওয়ার আগপর্যন্ত শর্করা স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। এটি সাধারণত সন্তান প্রসবের পর আর থাকে না। তবে পরবর্তী সময়ে গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। গবেষণা বলছে, যাঁদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ছিল, তাঁদের মধ্যে ১ দশমিক ৭ শতাংশ এক বছরের মাথায়, ১৭ শতাংশ ১০ বছরের মধ্যে আর ২৫ শতাংশ ১৫ বছরের মধ্যে পূর্ণ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন।

ঝুঁকি কাদের বেশি?

ওজনাধিক্য: যেসব নারী গর্ভসঞ্চারের আগে থেকেই স্থূল বা বেশি ওজনে ভুগছেন। এ ছাড়া যাঁদের গর্ভাবস্থায় ওজন অতিরিক্ত বেড়ে যায়। অতি ওজন ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

পারিবারিক ইতিহাস: যাঁদের ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস আছে।

আগে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস: যদি আগেরবার গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। অথবা আগে অতি ওজনবিশিষ্ট সন্তান জন্মের ইতিহাস থাকে।

বয়স: বয়স বাড়ার সঙ্গে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। ২৫ বছরের পর সন্তান নিলে ঝুঁকি বাড়তে থাকে।

অন্যান্য: যেসব নারীর পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের ইতিহাস আছে।

কীভাবে বুঝবেন

প্রত্যেক নারীর গর্ভাধারণের ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরামর্শ অনুযায়ী রক্তে শর্করা পরীক্ষা করতে হবে। কারণ, এই সময়টি তাঁদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিরূপণ করার সেরা সময় বলে বিবেচিত হয়। তবে ওপরে বলা ঝুঁকিগুলো যদি থাকে, তবে এই পরীক্ষা আরও আগেই করে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। শুরুতে স্বাভাবিক থাকলেও ২৪ সপ্তাহের পর আবার করতে হবে। এই পরীক্ষার নাম ‘ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট’।

বারবার তৃষ্ণা পাওয়া, দুর্বলতা ও ক্লান্তি, মুখের ভেতরে শুষ্ক হয়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘন ঘন প্রস্রাবে বা অন্য কোনো সংক্রমণ হলে ডায়াবেটিস সন্দেহ করতে হবে।

চিকিৎসা

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন সবচেয়ে নিরাপদ। এ সময় ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ওষুধ সেবন না করা ভালো।

যাঁদের গর্ভসঞ্চারের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে এবং মুখে খাওয়ার ওষুধ খাচ্ছেন, তাঁদের গর্ভসঞ্চার হয়েছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই মুখে খাওয়ার ওষুধ বন্ধ করে ইনসুলিন ব্যবহার শুরু করতে হবে।

তবে অনেকের ক্ষেত্রে কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং মাঝারি ধরনের শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ রাখা সম্ভব। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল বিষয়গুলো হলো সঠিকভাবে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, পরিমিত হালকা ব্যায়াম, নির্দিষ্ট সময় অন্তর ডায়াবেটিসের মাত্রা নিরূপণ, নিয়মিত স্ত্রীরোগ অথবা ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া।

সঠিক পরিমাণে ও সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। রোগীকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট খাদ্যতালিকা মেনে চলতে হবে। খাদ্যতালিকায় দৈনিক ৪০ শতাংশ আমিষ, ৪০ শতাংশ শর্করা ও ২০ শতাংশ চর্বিজাতীয় খাবার বা ফ্যাট থাকতে পারে। একজন পুষ্টিবিদ বা একজন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো খাদ্যতালিকা মেনে চলতে হবে। ডায়াবেটিসের রোগীদের গর্ভাবস্থায় নিয়মিতভাবে হালকা হাঁটার অভ্যাস থাকা ভালো, তবে কোনো অবস্থাতেই কোনো ভারী ব্যায়াম নয়।

নিয়মিতভাবে রক্তের সুগার পরীক্ষা ও ইনসুলিনের মাত্রা মাপতে হবে। এ ছাড়া নিয়মিত রক্তচাপ মাপা, গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সেটা পরিমাপ করাও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো জটিলতা না থাকলে একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীর প্রসব স্বাভাবিকভাবে হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলেই অস্ত্রোপচার করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। প্রসবের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খেতে দিতে হবে।

যদি মায়ের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পশিয়া বা অন্য কোনো জটিলতা থাকে, বেশি ওজনের বাচ্চা অথবা গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি কম হয়, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি করা লাগতে পারে। প্রসবের সময় অবশ্যই মায়ের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা প্রতি লিটারে ৪.৫-৫ মিলিমোল রাখতে হবে।

জন্মের কিছুক্ষণের মধ্যেই বাচ্চার পায়ের গোড়ালি থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে বাচ্চার গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক আছে কি না। যদি গ্লুকোজের মাত্রা প্রতি লিটারে ২.২ মিলিমোলের নিচে নেমে যায়, তবে দ্রুত শিশুকে গ্লুকোজ দিতে হয়। মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে বাচ্চারও পরবর্তী সময়ে স্থূলকায় হওয়ার এবং টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সন্তান প্রসবের পর বেশির ভাগ নারীর শর্করা স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে আসে। কিন্তু তবু প্রসবের ছয় সপ্তাহ পর মায়ের রক্তে আবার ওজিটিটি পরীক্ষা করতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক থাকলেও প্রতিবছর কমপক্ষে একবার করে পরীক্ষা করা ভালো। কারণ, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে পরবর্তী সময়ে টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।