গেজ বা অ্যানাল ফিশার: লজ্জা বনাম চিকিৎসা
মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষে যখন প্রথম ক্লিনিকাল ক্লাস করতে আসি, মেডিসিনের লিজেন্ড প্রয়াত অধ্যাপক রফিক উদ্দিন বললেন, তোমাদের ক্লিনিক্যাল আই এতখানি শার্প হতে হবে যে রোগীকে দেখামাত্রই একটা ডায়াগনসিসে চলে আসতে হবে। পরে রোগীর বাকি কথা শুনে, পরীক্ষা করে হয়তোবা সেটা ভুল প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু অভিজ্ঞতা হলে দেখবা বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই স্পট ডায়াগনসিস হয়ে যায়।
স্যারের কথায় সেদিন মনে মনে খুব হেসেছিলাম। আর আনমনে বলেছিলাম, এগুলা শুধু গল্পের বইয়েই সম্ভব। কিন্তু এখন ১৬ বছরের ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস শেষে জানি, স্যারের কথা কতখানি সত্য।
সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী কোনো রোগী যখন চেম্বারে ঢোকেন, তাঁর চেহারায় মিশে থাকা অপ্রস্তুত ভাব, কিছুটা লজ্জা মেশানো হাসি আবার ব্যথা চেপে রাখার কৌশল—এ সবকিছু মিলিয়ে রোগী কিছু বলার আগেই আমার ডায়াগনসিস হয়ে যায়। রোগীকে সহজ করতে আমি নিজে থেকেই প্রশ্ন করে ফেলি, আপনার কি পায়খানার রাস্তার সমস্যা? তখন তিনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।
আমাদের সমাজে রোগবালাইকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয়। আর পায়খানার কোনো রোগ হলে তো কথাই নেই। অধিকাংশ রোগীই এ সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে না এসে কবিরাজের কাছে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। হয়তো রাস্তার ধারের পোস্টার, চটকদার বিজ্ঞাপন এর প্রধান কারণ। তাদের অপচিকিৎসায় রোগীর ক্ষতি হয় অনেক। প্রশ্ন আসতে পারে, তাদের কাছে এত মানুষ তাহলে যায় কেন? এর রহস্য কী? এ রহস্য আমি আজকে ব্যাখ্যা করব।
যখন কোনো রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে, কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে অনেক ক্ষেত্রেই তা ঠিক হয়ে যায়। গেজ বা অ্যানাল ফিশার এ রকমই একটা রোগ। এ জন্য কবিরাজি চিকিৎসায় বেশির ভাগ রোগীই সেরে ওঠেন। কিন্তু যে কেসগুলো একটু কঠিন, সেগুলো চিকিৎসা করাতে গিয়ে তারা অ্যাসিড ব্যবহার করে রোগীর পায়ুপথের বারোটা বাজিয়ে দেন। তখন সে রোগী সারা জীবন কষ্ট পান। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, একজন ডাক্তারের চেয়ে কবিরাজের কাছে চিকিৎসার খরচও বেশি। বেশি টাকা দিতে হয় বলে রোগীরা বোধ হয় আরও আস্থা পান।
গেজ বা অ্যানাল ফিশার আসলে কী?
আমাদের পায়খানার রাস্তার বাইরের দিকে দুই ইঞ্চির মতো জায়গা খুব স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল। একে বলা হয় অ্যানাল ক্যানাল। এর সংবেদনশীলতার কারণে একে বিকৃত যৌনতার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
কোনো কারণে পায়খানা বেশি শক্ত হলে, জোর দিয়ে পায়খানা করতে গেলে অথবা যৌন সম্ভোগের সময় এর আবরণ ছিড়ে যেতে পারে। আর ঠিক তখনই একটা তীব্র ব্যথা অনুভব হয়। কেউ কেউ বলেন, যেন শুকনো মরিচবাটা লাগিয়ে দিয়েছে, আবার কেউ বলেন যেন ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে দিচ্ছে, এ রকম অনুভূতি হয়। এর সঙ্গে টাটকা লাল রক্তও ঝরতে পারে, যা রোগীর মনে আতঙ্ক তৈরি করে।
তবে মূল সমস্যা শুরু হয় এর পর। তার কারণ হলো আমাদের লজ্জা। এ দেশে ছেলেরাও সহজে এ সমস্যার কথা বলতে পারেন না। তবে অনেকে আধুনিক। তাঁরা মুঠোফোনে মলদ্বারের ছবি তুলে নিয়ে চেম্বারে আসেন। এটাও মন্দের ভালো। ছবি দেখেও রোগ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়।
তবে যাঁরা সংকোচ কাটাতে পারেন না, তাঁরা আরও বেশি সমস্যায় ভোগেন। তাঁদের অনেকেই ব্যথার ভয়ে পায়খানা চেপে রাখেন। ফলে তাঁদের প্রেশার বেড়ে যায়, মাথা ঘোরায়, ঘুম হয় না, খাবার হজম হয় না, গ্যাসের সমস্যা বাড়ে, সেই সঙ্গে সব সময় দুশ্চিন্তা আর অস্থিতায় ভোগেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে যে ব্যথা হয়, তার জন্য সহজ নিদান হলো, একটা বড় গামলায় হালকা গরম পানি নিয়ে তাতে আক্রান্ত স্থানসহ ডুবিয়ে ১৫-২০ মিনিট বসে থাকা। দিনে দুবার আর পায়খানার পরপর বসতে পারলে মাংসপেশি শিথীল হয়ে ব্যথাটা কমে আসে।
অ্যানাল ফিশার কেন হয়?
রেড মিট মানে গরু, খাসি বা শূকরের মাংস বেশি খেলে, ফাস্টফুড বা ভাজাপোড়া বেশি খেলে আর শাকসবজি, ফলমূল ও পানি কম খেলে পায়খানা শক্ত হয়। তাই খাবার পরিবর্তন করলেই এ সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যায়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু লেক্সেটিভ, পাকা পেঁপে বা ইসবগুলের ভূষি খেলে আরাম পাবেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে যে ব্যথা হয়, তার জন্য সহজ নিদান হলো, একটা বড় গামলায় হালকা গরম পানি নিয়ে তাতে আক্রান্ত স্থানসহ ডুবিয়ে ১৫-২০ মিনিট বসে থাকা। দিনে দুবার আর পায়খানার পরপর বসতে পারলে মাংসপেশি শিথীল হয়ে ব্যথাটা কমে আসে। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে যে কখনো চাপ দিয়ে বা জোর করে পায়খানা করা যাবে না।
এসব পদ্ধতিতে যদি রোগ না সারে, তাহলে কী করণীয়?
তাহলে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক বা সার্জনকে দেখান। তিনি আক্রান্ত স্থান পরীক্ষা করে পরামর্শ দেবেন যে রোগটা ওষুধে সেরে যাবে, নাকি অস্ত্রোপচার লাগবে।
অস্ত্রোপচার কীভাবে করা হয়, আর কী করা হয়?
এটা স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার। সাধারণত সিজারের মতো কোমরের নিচ থেকে অবশ করে এটি করা হয়। এতে মলদ্বারের ভেতরের দেয়ালের একটি মাংসপেশি কিছুটা কেটে দেওয়া হয়। এতে মলদ্বার শিথিল হয়ে আসে। ফলে পায়খানা শক্ত হলেও তা সহজে বেরিয়ে আসতে পারে। একই সঙ্গে মলদ্বারে ঝুলে থাকা অতিরিক্ত চামড়া কেটে ফেলা হয়।
অস্ত্রোপচারের পর কি সমস্যা দেখা দিতে পারে?
মলদ্বারের যেকোনো অস্ত্রোপচারের পর পুরোপুরি সেরে উঠতে কিছুদিন সময় লাগে। যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের ক্ষত শুকাতে বেশি সময় লাগতে পারে। তবে অপারেশনের পরদিন থেকেই বাসায় গিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে পারবেন। প্রথম কিছুদিন মলদ্বার থেকে রস ঝরতে পারে। তবে অন্তর্বাসের নিচে টিস্যু রেখে দৈনন্দিন সব কাজ করা সম্ভব।
এটা কি আবার হতে পারে?
খুব বিরল। তবে মলদ্বারে বারবার সংক্রমিত হলে মলদ্বার সরু হয়ে যেতে পারে। তখন আরেকটি অস্ত্রোপচার বা ডাইলেশন বা প্রসারিতকরণ করা প্রয়োজন হতে পারে।
—ডা. রেজা আহমদ
সহকারী অধ্যাপক, জেনারেল ও লেপারোস্কোপিক সার্জন,
সিলেট সেন্ট্রাল ডেন্টাল কলেজ, সিলেট।