জীবন সত্যিই বড় সুন্দর

জীবন বড় সুন্দর—অসাধারণ এই জীবনবোধ নিয়ে আলাপ করা বোধ হয় তাঁরই শোভা পায়, যিনি জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এসেছেন। তেমনই একজন বলছিলেন কথাটা। ২৮ দিন অচেতন অবস্থায় থাকার পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিজেকে আবিষ্কার, এই দীর্ঘ সময়ে ঘটে যাওয়া সব পরিবর্তনকে ধীরে ধীরে গ্রহণ করে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ভীষণ কঠিন লড়াই—এই স্মৃতিচারণা তাঁর জন্য সুখকর নয়। তবু আলাপ করতে রাজি হলেন। যখন কথা হচ্ছিল, তিনি ছিলেন ময়মনসিংহের পথে, ফিরছিলেন বগুড়া থেকে। গভীর কোমা থেকে উঠে কখনো আবার এমন হাইওয়ে ধরে ছুটে বেড়াতে পারবেন, সে আশা তাঁর স্বজনদেরও ছিল না। যাহোক, যাত্রাবিরতিতে আলাপ হলো মুঠোফোনে।

মো. সালেহ উদ্দীনকে কাছের মানুষেরা ডাকেন ‘রিগ্যান’ বলে। জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তাঁর জীবনের ভয়াবহ সেই দিনটি ছিল ২০১৯ সালের ১৩ আগস্ট। ময়মনসিংহ শহরে স্কুলের বন্ধুদের পুনর্মিলনী ছিল সেদিন। সেখান থেকে ফিরছিলেন নিজের মোটরসাইকেলে। পেছনের আসনে তাঁর বন্ধু। পথে আকস্মিক দুর্ঘটনা। মাইক্রোবাসের ধাক্কায় ভারসাম্য হারায় তাঁর বাহনটি। নিজে পড়ে যান, পেছনে বসা বন্ধুও ছিটকে গেছেন বেশ দূরে। বন্ধু ধাতস্থ হলেন একটু, কিন্তু সালেহ উদ্দীন আর উঠতে পারছিলেন না। একজন পিকআপ ভ্যানচালক দুর্ঘটনাটি ঘটতে দেখেন। তাঁর সহায়তায় সেই বন্ধুই তাঁকে নিয়ে যান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত পৌনে ৯টার দিকে ঘটেছিল দুর্ঘটনা। এরপর রাত দুইটা কি আড়াইটা পর্যন্ত জ্ঞান ছিল তাঁর।

সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর সালেহ উদ্দীন আবার চালাচ্ছেন নিজের প্রিয় বাইক

কী হলো এরপর? সালেহ উদ্দীনের স্মৃতির পটে এর ঠিক পরের দৃশ্যটি ঢাকার স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের আইসিইউর। ঘুম ভেঙেছে, সকাল হয়েছে, এবার অফিসে যেতে হবে—এটাই ছিল জ্ঞান ফেরার পর প্রথম ভাবনা। তবে অবাক হয়ে দেখলেন উঠতে পারছেন না বিছানা ছেড়ে। আর এ তো তাঁর ঘরও নয়। চারদিকে হাসপাতালের কর্মী, নার্স, কাচের ঘর আর নিজের শরীরে লাগানো অনেকগুলো নল। মনে পড়ে গেল দুর্ঘটনার কথা। তারপর বোধ হলো ‘মারা যাইনি আমি, সুস্থ হতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।’ বুঝতে পারছিলেন, মা-বাবার ওপর দিয়ে কী ঝড় যাচ্ছে, তাই সুস্থ হওয়ার তাগিদ অনুভব করতেন ভেতর থেকে। অজ্ঞান অবস্থায় শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখতে গলায় ছিদ্র (ট্রাকিওস্টোমি) করতে হয়েছিল, তাই কথা বলতে পারছিলেন না স্বাভাবিকভাবে। ইশারায় ভাব প্রকাশ করতে হচ্ছিল। জ্ঞান ফেরার পর আরও ৫ দিন ছিলেন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে, এরপর কেবিনে আরও ১১ দিন। বাসায় ফিরেছিলেন ২১ সেপ্টেম্বর।

কী হয়েছিল তাঁর? দুর্ঘটনায় পাঁজরের চারটি হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তবে মূল সমস্যাটি ছিল অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। লিভার (যকৃত) ও স্প্লিনায় (প্লীহা) মারাত্মক আঘাত লেগেছিল। রক্তক্ষরণ থামাতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল সেদিন। কিন্তু রক্তক্ষরণ থামানো যায়নি। রক্তক্ষরণের জায়গায় অনেক পুরু গজ বা মপ আটকে অস্থায়ী ব্যবস্থা করে জরুরিভাবে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয় তাঁকে। বন্ধুর সহায়তায় আকাশপথেই হয় সেই ব্যবস্থা।

প্রথমে ঢাকার বিআরবি হাসপাতাল লিমিটেডে নেওয়া হলো তাঁকে। জরুরি ভিত্তিতে করা হলো দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার। হেপাটো বিলিয়ারি সার্জন অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী ছিলেন সেই অস্ত্রোপচারের প্রধান শল্যচিকিৎসক। জটিল সেই অস্ত্রোপচার সফল হলো। প্রাণে বেঁচে গেলেন সালেহ উদ্দীন। কিন্তু রয়ে গেলেন অচেতন অবস্থায়, গভীর কোমায়। বন্ধুদের ইচ্ছায় আবার স্থানান্তর করা হলো তাঁকে। এবার নেওয়া হলো স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে। দুটি হাসপাতালের দূরত্ব সামান্য। কিন্তু এক আইসিইউ থেকে আরেক আইসিইউতে নেওয়াটাই তাঁর জন্য ছিল ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলেন, ঝুঁকি নেবেন।

কিন্তু স্থানান্তরের পর দেখা দিল আরেক সমস্যা। রক্ত জমাট বেঁধে অন্ত্রে পচন ধরতে শুরু করেছে (গ্যাংগ্রিন)। পচে যাওয়া অংশ ফেলে দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। আবারও অস্ত্রোপচার। এবার দুঃসাধ্য কাজটা করলেন অধ্যাপক মো. সানোয়ার হোসেন। অস্ত্রোপচার সফল হলো। তত দিনে আবার শরীরে বাসা বেঁধেছে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী শক্তিশালী জীবাণু। সংক্রমণ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। এত সব জটিলতার বিরুদ্ধে চলল মরণপণ লড়াই। অবশেষে এ লড়াইয়ে জয়ী হলেন তিনি আর তাঁর চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকেরা। জয়ী হলেন তাঁরা, যাঁরা পুরোটা সময় সেবা দিয়েছেন তাঁকে। প্রিয় বন্ধুরা ছাড়াও পরিবারের পাশে ছিলেন সহকর্মীরা। অসুস্থ কর্মীর জন্য নতুন নীতিমালাও তৈরি হয়েছিল তাঁর বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। আসলে জয় হলো মানবতারই, মানুষের অপ্রতিরোধ্য সদিচ্ছার।

আইসিইউতে থাকার অভিজ্ঞতাটা ছিল দুঃসহ। সালেহ উদ্দীনের ভাষায়, ‘আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেউ এই পরিস্থিতিতে না পড়লে তাকে এ ব্যাপারটা বলে বা লিখে বোঝানো যায় না।’ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে জ্ঞান ফেরার পর নিজের চেহারা দেখেননি, কেবিনে ফেরার পর ওয়াশরুমের আয়নায় তাকিয়ে দেখেন ভীষণ কালো এক কিম্ভূত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। নিজেকে চেনাই দায়। মা ভরসা দিয়েছিলেন। বাসায় ফেরার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার নতুন লড়াই। শরীর হয়ে পড়েছিল ভীষণ দুর্বল। সামান্য দূরত্ব হাঁটলেই হাঁপিয়ে উঠতেন। আবার বাসায় ‘পড়ে’ থাকতেও ভালো লাগত না। কষ্ট করে চেষ্টা করতেন নিজেই সুস্থ হয়ে উঠতে। অসীম মনোবল দরকার হয় তাতে।

জীবন এখন স্বাভাবিকের খুব কাছাকাছি। আগের মতো করতে পারছেন প্রায় সবই। গত ডিসেম্বরেই ফিরে গিয়েছেন কর্মক্ষেত্রে। কাজের সুবাদে বাসার বাইরে থেকেও বাজার করে, রান্না করে অফিস করেছেন। দুর্ঘটনার পর মোটরসাইকেলটি পড়ে ছিল ময়মনসিংহের বাসার নিচে। সেটাও সারিয়ে নিয়েছেন। এখন নিজেই চালান আবার সেই বাহন। গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন। নিজেদের বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুরেও ঘুরতে গিয়েছেন সুস্থ হওয়ার পর। আগের মতোই ভালো লাগার কাজগুলো করেন। কোনো বিষয়ে চাপ নেন না নিজের মধ্যে। গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, জীবন ক্ষণিকের, কিন্তু বড় সুন্দর।

লেখক: চিকিৎসক