ডায়াবেটিস চিকিৎসায় সপ্তাহে এক দিন ব্যবহারের ওষুধ

বিশ্বে প্রায় ৪২ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রায় ৮৪ লাখ। এর মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি (৯০-৯৫ শতাংশ)। ডায়াবেটিস জীবনব্যাপী রোগ, যা থেকে প্রাণঘাতী বিভিন্ন জটিলতা যেমন—হৃদ্‌রোগ, কিডনি সমস্যা, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, স্নায়ুর সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে নেই। নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা না করা, নিয়মিত ওষুধ সেবন না করা, অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণ, ইনজেকশন–ভীতি ইত্যাদি। এ ছাড়া ওজন ডায়াবেটিস রোগীর একটি প্রধান উদ্বেগের কারণ। ওজন নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বর্তমানে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় মুখে খাবার ট্যাবলেট ও নানা ধরনের ইনজেকশন, যেমন: ইনসুলিন, জিএলপি-১ রিসেপ্টর এগোনিস্ট ইত্যাদি দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে। মুখে খাওয়া ওষুধ রোগীদের বেশি পছন্দ হলেও এসব ওষুধের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন: অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ কার্যকর না থাকলে ওষুধ কাজ করে না। তা ছাড়া কিছু ওষুধ ওজন বাড়ায়, কোনোটা বদহজম করে, কিছু ওষুধ কিডনি বা যকৃৎ সমস্যা থাকলে খাওয়া নিষেধ। এ ক্ষেত্রে রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন হলো সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিনের কার্যকারিতা সর্বাধিক ও নিরাপদ হওয়া সত্ত্বেও বেশির ভাগ রোগী ইনসুলিন নিতে অনিচ্ছুক ইনজেকশন–ভীতি, রক্তে আকস্মিক শর্করা কমে যাওয়া এবং ওজন বৃদ্ধির কারণে। সে ক্ষেত্রে জিএলপি-১ রিসেপ্টর এগোনিস্ট ইনজেকশন সপ্তাহে একবার ব্যবহারে রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ, হৃদ্‌রোগ ও কিডনি জটিলতা, হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি কমানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে

পাঁচ দশক ধরে বিজ্ঞানীরা ডায়াবেটিসের রোগীর এই প্রচলিত সমস্যাগুলো কমানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন ব্যবহারযোগ্য ইনজেক্টেবল ও মুখে খাওয়ার ওষুধের পাশাপাশি সপ্তাহে এক দিন ব্যবহারযোগ্য জিএলপি-১ রিসেপ্টর এগোনিস্ট (যেমন, ডুলাগ্লুটাইড) বর্তমানে বাংলাদেশেও সহজলভ্য হয়েছে, যা রক্তে কার্যকরভাবে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ওষুধ অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণ ক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি ডায়াবেটিসের জটিলতা যেমন হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়, ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যুর ঝুঁকিও কমায় বলে প্রমাণিত। এ ছাড়া গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে ডুলাগ্লুটাইড বিটা কোষকে আবার কার্যক্ষম করে তোলে। ফলে শরীরের ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

জিএলপি-১ রিসেপ্টর এগোনিস্টের এ ধরনের নানামুখী উপকারিতা প্রমাণিত হওয়ায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন: আমেরিকান ডায়াবেটিক সংস্থা, ইউরোপীয় ডায়াবেটিস ও কার্ডিওলজিস্ট সংস্থা ডায়াবেটিস রোগী, যাঁদের হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি ও জটিলতা রয়েছে, তাঁদের জন্য এটি বিশেষভাবে অনুমোদন দিয়েছে। সপ্তাহে এক দিন ব্যবহারযোগ্য ডুলাগ্লুটাইড রক্তের এলডিএল কোলেস্টেরল কমানো, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, ওজন কমানো এবং রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদ্‌রোগের প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি লক্ষণগুলোকে প্রতিরোধ করে থাকে। এ ছাড়া পরীক্ষায় দেখা গেছে, ডুলাগ্লুটাইড রক্তনালিকার কার্যকারিতা বাড়ায় ও রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে। ফলে স্ট্রোকের সম্ভাবনা ও কমে যায়। ডায়াবেটিস রোগীদের অনেকেই স্থূল বা অতি ওজনের অধিকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, ডুলাগ্লুটাইড ব্যবহারে ওজনও কমে।

এ ছাড়া ডুলাগ্লুটাইড রক্তের গ্লুকোজের গড় এইচবিএওয়ানসি কমানোর পাশাপাশি ডায়াবেটিসজনিত কিডনি জটিলতাগুলোকে কমায় ও প্রস্রাবে আমিষ নির্গমনের হারও কমায়।

ডুলাগ্লুটাইড ইনজেকশনের ডিভাইসটিও রোগীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে। এই ডিভাইসে সুচটি লুকানো থাকে, যা রোগীদের সুচভীতি দূর করে।

ডায়াবেটিসের রোগীর জন্য এমন চিকিৎসা পদ্ধতি গবেষকেরা খুঁজছেন, যা সহজে ব্যবহারযোগ্য, যা রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ডায়াবেটিস–সম্পর্কিত জটিলতা প্রতিরোধ ও ওজন কমাতে সাহায্য করবে। এই কাঙ্ক্ষিত পথে ডুলাগ্লুটাইড একটি পদক্ষেপ।