দীর্ঘমেয়াদি কোমরের ব্যথা

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

বিভিন্ন ধরনের জরিপ থেকে দেখা যায়, শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় কোমরব্যথায় ভোগেন। এই ব্যথা সাধারণত দুই ধরনের। এক. স্বল্পমেয়াদি ব্যথা যা এক মাসের কম সময় থাকে। দুই. দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক ব্যথা যা এক মাসের অধিক সময় থাকে। বেশির ভাগ মানুষ স্বল্পমেয়াদি ব্যথায় ভোগেন। কিন্তু যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক ব্যথায় ভোগেন, তাঁদের অবশ্যই চিকিৎসা প্রয়োজন। উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করলে ৯০ শতাংশ রোগী দুই মাসের মধ্যে ভালো হয়ে যান।

ডা. বিলকিস ফাতেমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও বাত ব্যথা বিশেষজ্ঞ ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ

প্রথম আলো আয়োজিত এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ব্যথার সাতকাহনে এ বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করেন অতিথিরা। ৩১ অক্টোবর প্রচারিত হয় অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্ব। এ পর্বের প্রতিপাদ্য ছিল: দীর্ঘমেয়াদি কোমরের ব্যথা। ডা. বিলকিস ফাতেমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও বাত ব্যথা বিশেষজ্ঞ ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ।

অনুষ্ঠানটি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ ছাড়া সম্প্রচারিত হয় এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকেও।

কোমরের ব্যথা আসলে কী এবং কী কী কারণে এটি হতে পারে—এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ বলেন, কোমরের পাঁচটি হাড় আছে। এই হাড়গুলোতে ব্যথা অনুভূত হলেই সাধারণত আমরা একে কোমরব্যথা বলি। কিন্তু এই ব্যথার অনেক ধরন রয়েছে। একেক জনের কোমরব্যথার কারণ একেক রকম। বেশ কিছু রোগও এর জন্য দায়ী।

কোমরের হাড়গুলো যদি বয়সের কারণে বা বংশগত কারণে ক্ষয় হয়ে যায়, তখন তাকে লাম্বার স্পনডেলাইসিস বলে। এর জন্যও কোমরব্যথা হয়। আবার মানুষের হাড়ের মধ্যে ফাঁকা জায়গা থাকে। এটি পূরণ থাকে তালের শাঁসের মতো ডিস্ক বা চাকতি দিয়ে। এ ডিস্ক যদি কোনো কারণে বের হয়ে যায়, তখন স্নায়ুমূলের ওপরে চাপ ফেলে। এর ফলে কোমরে ব্যথা হতে পারে।

বড় কোনো আঘাতের ইতিহাস থাকলে, কোমরব্যথার পাশাপাশি বুকে ব্যথা হলে, রোগীর আগে কখনো যক্ষ্মা হয়ে থাকলেও বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। ক্যানসার, অস্টিওপোরোসিস, এইডস, দীর্ঘকাল স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনের ইতিহাস থাকলে কোমরব্যথাকে অবহেলা করা চলবে না। ব্যথার পাশাপাশি জ্বর, শরীরের ওজন হ্রাস, অরুচি, অতিরিক্ত ঘাম ইত্যাদি উপসর্গ থাকলে এবং ব্যথাটা কোমর ছাড়িয়ে পায়ের দিকে বিশেষ করে এক পায়ের হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ছড়ালে অথবা এক পায়ে তীব্র ব্যথা বা অবশভাব হলে সতর্ক হতে হবে। প্রস্রাব বা পায়খানার সমস্যা, মলদ্বারের আশপাশে বোধহীনতা, মেরুদণ্ডে বক্রতা, পায়ের দুর্বলতা বা পায়ের মাংসপেশির শুষ্কতা ইত্যাদি উপসর্গকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

এ ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন কিছু কাজ থেকেও কোমরে স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা হতে পারে। যেমন অফিসে দীর্ঘক্ষণ বসে একই ভঙ্গিতে কাজ করলে। দীর্ঘ সময় ড্রাইভিং করলে বা বেশি সামনে ঝুঁকে গাড়ি চালালে। ড্রাইভিংয়ের সময় পেছনে কিছু সাপোর্ট নেওয়া উচিত। বসার চেয়ার টেবিল ঠিকমতো না বসলে। কিংবা সামনে-পেছনে ঝুঁকে বসলে কোমরে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। যাঁরা শুয়ে বা কাত হয়ে বই পড়েন বা অন্য কাজ করেন, তাঁদের মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ব্যথা অনুভূত হয়। অনেকেই আছেন যাঁরা কোনো ভারী জিনিস সঠিক নিয়মে তোলেন না। ফলে মেরুদণ্ডে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে এবং তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যথা হয়।

কোমরব্যাথা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। এ বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা করেন ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেকেই কোমরব্যথাকে কিডনি রোগ ভেবে ভুল করে। জেনে রাখা দরকার, কিডনি রোগের উপসর্গগুলোর একটি কোমরব্যথা হলেও এর আরও অনেক কারণ রয়েছে। কিডনি রোগই এর একমাত্র কারণ নয়। আবার রোগভেদে কোমরে ব্যথার তীব্রতারও তারতম্য হয়। তাই কোমরে ব্যথা মানেই কিডনি রোগ এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। এ জন্য প্রয়োজন সঠিক রোগনির্ণয়। এ জন্য কিছু পরীক্ষা রয়েছে। যেমন কোমরের এক্স-রে ও এমআরআই, ফরোয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড বন্ডিং পরীক্ষা।

নিউরোলজিক্যাল ডেফিসিয়েন্সি আছে কি না, তা নির্ণয় করা। রক্তেরও বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগনির্ণয় করা যায়; যেমন ক্যালসিয়ামের পরীক্ষা, ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ, শরীরে বাত আছে কি না, তা জানা। ক্রনিক ব্যাক পেনের ক্ষেত্রে এইচএলএবি-২৭ পরীক্ষা করে নেওয়া যেতে পারে।

কোমরব্যথার কিছু করণীয় সম্পর্কে ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ জানান, ঝুঁকে বা মেরুদণ্ড বাঁকা করে কোনো কাজ করা যাবে না। শক্ত–সমান বিছানায় ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। ফোমের বিছানায় এবং ফোমের নরম সোফায় যতটা সম্ভব পরিহার করতে হবে। নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। অথবা নিয়মিত ব্যায়াম অথবা হাঁটার অভ্যাস করতে হবে।

ঘাড়ে ভারী কিছু তোলা উচিত নয়। নিতান্তই দরকার হলে ভারী জিনিসটি শরীরের কাছাকাছি এনে কোমরে চাপ না দিয়ে তোলার চেষ্টা করুন। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একই ভঙ্গিমায় একই জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে অথবা বসে থাকা যাবে না। ঘুমের সময় সোজা হয়ে ঘুমাতে হবে। বেশি নড়াচড়া করা যাবে না। ঘুম থেকে ওঠার সময় যেকোনো একদিকে কাত হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। কোমরব্যথা বেশি গুরুতর হলে অবহেলা না করে অতি দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।