শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে মধ্যবয়সী ও বয়স্কদের মধ্যে বাতব্যথা প্রচলিত একটি সমস্যা। অনেকে দীর্ঘদিন এই ব্যথায় ভোগেন অথচ বুঝতে পারেন না কোথায় কোন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, কি করতে হবে এই ব্যথা উপশমের জন্য। দীর্ঘকালীন বাতব্যথা নিয়ে আলোচনা হলো এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘করোনাকালে অসুখ-বিসুখ’-এর ষষ্ঠ পর্বে।
এবারের বিষয় ছিল ‘দীর্ঘমেয়াদি বাতব্যথা’। শ্রাবন্য তৌহিদার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও বাতব্যথা বিশেষজ্ঞ ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ। অনুষ্ঠানটি ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বাতব্যথা নিয়ে একটি প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়। আমাদের শরীরের হাড়, মাংস, অস্থিসন্ধিতে দীর্ঘমেয়াদি যে ব্যথা হয়ে থাকে সেটাকে বাতব্যথা বলে থাকে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যখন কোনো ব্যথা ছয় সপ্তাহ অর্থাৎ দেড় মাসের বেশি সময় ধরে স্থায়ী থাকে, তখন সেই ব্যথাকে দীর্ঘমেয়াদি বাতব্যথা বলা হয়।
এই বাতের ব্যথাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন যখন হাত–পা–হাঁটুর গিরায় ব্যথা হয়, তখন তাকে ইনফ্ল্যামেটরি জয়েন্ট ডিজিজ বলা হয়। এ সময় ব্যথার পাশাপাশি হাত–পায়ের গিরা ফুলে যায়। সকালের দিকে ঘুম থেকে ওঠার পর ব্যথার মাত্রা বেড়ে যায়। অর্থাৎ বিশ্রামের পর ব্যথা বেড়ে যায়। এ ধরনের লক্ষণ কারও দেখা দিলে ধরে নিতে হবে যে তিনি বাতের সমস্যায় আক্রান্ত এবং তখনই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
বয়সভেদে বাতব্যথার তারতম্য হয়ে থাকে। ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সী—সবাই কোনো না কোনো বাতব্যথায় আক্রান্ত হতে পারেন। একদম অল্প বয়সের বাতব্যথাকে জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস বলা হয়। এটি ৬ মাস বয়স থেকে ১৬ বছর বয়সীদের বেশি হয়ে থাকে। এই ব্যথায় আক্রান্ত রোগীদের গিরায় ব্যথার পাশাপাশি মাংসপেশিতেও ব্যথা হয়ে থাকে। এমনকি মেরুদণ্ডেও ব্যথা করতে পারে। আবার তরুণ বয়সীদের একধরনের বাত হয়ে থাকে যাকে বলে স্পন্ডিলো আর্থ্রাইটিস। আবার কিছু কিছু বাত আছে যেটা বাচ্চা মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। এই বাতের সমস্যাকে সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমেটোসাস বলে।
৪৫ বছর বয়সের পরে কিছু কিছু বাতব্যথা হয়ে থাকে। বৃদ্ধ বয়সীদের বাতব্যথাকে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বলে। ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাড়ের ক্ষয়জনিত আর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে, যা অস্টিওআর্থ্রাইটিস নামে পরিচিত।
পৃথিবীতে দুরকমের রোগ দেখা যায়। নিরাময়যোগ্য ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। বেশির ভাগ বাতব্যথা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। অর্থাৎ খুব কম ক্ষেত্রে বাতব্যথা পুরোপুরি নিরাময় করা যায়। ওষুধ, সঠিক ব্যয়াম এবং ভালো জীবনধারা মেনে চললে এই ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
বেশির ভাগ বাতব্যথা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। অর্থাৎ খুব কম ক্ষেত্রে বাতব্যথা পুরোপুরি নিরাময় করা যায়। ওষুধ, সঠিক ব্যয়াম এবং ভালো জীবনধারা মেনে চললে এই ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব
বাতের ব্যথা নির্ণয়ের জন্য প্রথমে ক্লিনিক্যাল ডায়াগনসিস করতে হয়। এতে বাতের ধরন বোঝা না গেলে ইনভেস্টিগেশন বা টেস্ট করার প্রয়োজন হয়। যেমন রিউমাটয়েড বাতের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি বা অ্যান্টিসিসি, স্পন্ডিলো আর্থ্রাইটিস নির্ণয়ের জন্য এইচএলএ-বি টোয়েন্টি সেভেন, সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমেটোসাসের জন্য এনএ, এনটিডিএস ডিএনএ ইত্যাদি টেস্টগুলো করা হয়ে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রেডিওলজিক্যাল টেস্ট, এক্স–রে করার দরকার হয়।
বাতব্যথার চিকিৎসার প্রথম ধাপেই ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়। বাতের ধরনভেদে ওষুধের ভিন্নতা দেখা দেয়। যেমন স্পন্ডিলো আর্থ্রাইটিসে প্রথমে শুধু ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়। আবার রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগীদের ব্যথানাশক ওষুধের পাশাপাশি এমন আরও কিছু ওষুধ দেওয়া হয় যেগুলো ব্যথা ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। এরপর একটা সময় দেখা যায় তাদের আর ব্যথানাশক ওষুধের প্রয়োজন হয় না।
ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ব্যথানাশক দিতে গেলে সাধারণত চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ সতর্কতা পালন করতে হয়। উচ্চমাত্রার ওষুধ না দিয়ে নিম্নমাত্রার ওষুধ দিতে হবে। আর যেকোনো ব্যথানাশক দেওয়ার আগে অবশ্যই কিডনি ও লিভারের একটি পরীক্ষা করে নিতে হবে। এ ছাড়া জেনে নিতে হবে রোগীর খাদ্যনালিতে কোনো সমস্যা ছিল কি না। বয়স, অন্যান্য রোগের ইতিহাস শুনে–বুঝে একজন রোগীর জন্য চিকিৎসকেরা সঠিক ওষুধ বাছাই করে থাকেন।
ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিশেষভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। অনেকেই আছে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ইচ্ছেমতো উচ্চমাত্রার ব্যথার ওষুধ খেয়ে ফেলে। এটি শুধু বাতের ব্যথায় নয়, সব ধরনের ব্যথায় এমনটি করে থাকে। এর ফলে কিডনি, লিভারে নানা রকম জটিলতা, খাদ্যনালিতে ঘা হওয়ার মতো গুরুতর সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তাই যেকোনো রকমের ব্যথানাশক ওষুধ অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে খেতে হবে। ঠিক যতটুকু, যত দিন প্রেস্ক্রাইব করা হবে, ঠিক তত দিনই নিতে হবে।
বাতের ব্যথার রোগভেদে চিকিৎসকও যে ভিন্ন হয়ে থাকেন, এটা সম্পর্কে অনেকে আমরা জানি না। যাদের অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয়ে ফুলে যায়, সকালে ঘুম থেকে উঠলে ব্যথার মাত্রা বেড়ে যায়, আবার কাজ করতে করতে ব্যথা কমে যায়, তাদের অবশ্যই রিউমাটোলজিস্টের কাছে যেতে হবে। তবে দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে রিউমাটোলজিস্ট অনেক আছেন, তবে সরকারি হাসপাতালে আলাদা কোনো বিভাগ না থাকায় এর চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ডিপার্টমেন্ট আছে যেখানে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়।
ব্যথার ওষুধের সঙ্গে কিডনি নষ্ট হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। অনেক ব্যথার ওষুধ এটি বিকল করে দিতে পারে। এনএসআইডি বা নন স্টেরয়েড ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ শ্রেণির ব্যথানাশক কিডনির ওপর প্রভাব ফেলে। আবার কিছু ওষুধ আছে যা নিরাপদ।
মাংসপেশি বা মাংসে ব্যথা, আঘাতজনিত দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা, স্নায়ুতে চাপজনিত ব্যথার ক্ষেত্রে একজন সার্জনের কাছে যেতে হবে। অনেকের অঙ্গবিকৃতি থাকে, তখন অবশ্যই ফিজিয়াট্রিক কেয়ার নিতে হবে। আবার যেকোনো ব্যথাজনিত রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসার জন্য একজন মেডিসিন স্পেশালিস্টকে দেখানো যাবে।
ব্যথার ওষুধের সঙ্গে কিডনি নষ্ট হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। অনেক ব্যথার ওষুধ এটি বিকল করে দিতে পারে। এনএসআইডি বা নন স্টেরয়েড ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ শ্রেণির ব্যথানাশক কিডনির ওপর প্রভাব ফেলে। আবার কিছু ওষুধ আছে যা নিরাপদ। নারকোটিক শ্রেণির ওষুধ প্যাথিডিন, নন–নারকোটিক ওষুধ ট্রামাডল হাইড্রোক্লোরাইড জাতীয় ওষুধে কিডনির ওপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম। তাই বাতের ব্যথায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবনের কোনো বিকল্প নেই।
অনুষ্ঠানের শেষে ডা. মো. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদ দর্শকদের বাতব্যথাসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।