নাক কান গলার সমস্যা উপেক্ষার নয়

ডা. শ্রাবন্য তৌহিদার ডা. শ্রাবন্য তৌহিদার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন ডা. সুব্রত ঘোষ

আমাদের দেশে নাক-কান-গলার সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঠান্ডার কারণে সমস্যা সৃষ্টি হতে দেখা দেয়। কিন্তু ঠান্ডাজনিত সমস্যা ছাড়াও নাক-কান-গলার আরও অনেক জটিল অসুখ হতে পারে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। আর এই নাক-কান-গলার নানা রকমের সমস্যা ও চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান এসকেএফ নিবেদিত ‘করোনাকালের অসুখ-বিসুখ’-এর অষ্টম পর্বে।

অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও নাক-কান-গলা রোগবিশেষজ্ঞ ডা. সুব্রত ঘোষ। সঞ্চালনায় ছিলেন ডা. শ্রাবন্য তৌহিদা। অনুষ্ঠানটি ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

প্রথমে নাক-কান-গলার বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে জানা গেল। গলার সমস্যার মধ্যে আছে টনসিল, যেটি ছোট বাচ্চাদের অনেক বেশি হয়। শিশু আর বৃদ্ধদের গলায় খাবার বা অন্য কিছু আটকে যাওয়ার সমস্যা দেখা যায়। নারীদের ফ্যারিঞ্জাইটিস নামের গলার সংক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। এগুলো খুবই সাধারণ কিছু গলার অসুখ। এ ছাড়া অনেক সময় হঠাৎ করে গলায় ব্যথা হয়, খাবার গিলতে সমস্যা হয়। এগুলো গলার কোনো ইনফেকশন বা গলা বা খাদ্যনালিতে টিউমারের লক্ষণ।

কানের সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে কান পাকা, কানে কম শোনা বা আঘাতজনিত সমস্যা। আর নাকের  সাধারণ সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে নাকের হাড় বাঁকা, নাকের ভেতর মাংস বৃদ্ধি, সাইনাস প্রভৃতি। এ ছাড়া নাকে ক্যানসার ও টিউমারের মতো সমস্যাও  হয়ে থাকে।

আমাদের দেশে দেখা যায়, নাক, কান বা গলার কোনো সমস্যা হলে রোগীরা ইএনটি স্পেশালিস্টদের কাছে না গিয়ে মেডিসিন বা নিউরোমেডিসিন স্পেশালিস্টদের কাছে আগে যান। এর প্রধান একটি কারণ হচ্ছে নাক বা কানের সমস্যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাথাব্যথা হয়। এভাবে অন্য চিকিৎসকের কাছে গেলে রোগীর ঠিকমতো ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা হয় না। তাই এসবের কোনো সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই নাক-কান-গলা রোগবিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

অনুষ্ঠানে ডা. সুব্রত ঘোষ নাক ও কানের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। যেমন নাকের হাড় বাঁকা সমস্যা হলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মাথাব্যথা হয়। হাড় যদি অনেক বেশি বাঁকা থাকে, তাহলে সার্জারি করে সেটি সোজা করা যায়। তবে তার আগে পিএনএস সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে নাকে হাড়ের অবস্থা দেখে নিতে হবে। সঠিকভাবে সার্জারি করলে নাকের হাড় পুনরায় বাঁকা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে সেটি দ্রুত করতে হবে।

সাধারণ মানুষ তো বটেই, এ দেশে অনেক চিকিৎসকের মধ্যেও নাকের পলিপ নিয়ে একটি ভুল ধারণা আছে। বেশির ভাগ মানুষই মনে করেন, নাকের ভেতর মাংস বৃদ্ধি মানে পলিপ। এটি ঠিক নয়। নাকের পলিপ সাধারণত দুই রকমের। ইথমোডাইল ও এন্ট্রোকোঅ্যানাল। এ দুই ধরনের পলিপ এন্ডোস্কপি সাইনাস সার্জারি করে সহজেই অপসারণ করা যায়। সাইনাস সমস্যায়ও একই চিকিৎসা অর্থাৎ এন্ডোস্কপি সাইনাস সার্জারি করা হয়।

আরও পড়ুন

কানের যেকোনো সমস্যাই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। কানের সমস্যার মধ্যে একিউট ওটাইটিস মিডিয়া বা কান পাকা অত্যন্ত খারাপ একটি সমস্যা। কানের পর্দা ফেটে গেলে বা ইনফেকশন হলে এমন হয়ে থাকে। এতে কানে ব্যথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কান থেকে পানি বা পুঁজ বের হয়। অনেক সময় দেখা যায় কানের ইনফেকশন থেকে মস্তিষ্কেও ইনফেকশন হয়। এ ক্ষেত্রে কান পাকার সমস্যা হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় গেলে সাধারণ চিকিৎসায় ইনফেকশন সারানোর ওষুধ বা অ্যান্টি হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে রোগীকে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। যেমন ইনফেকশন অবস্থায় কান না খোঁচানো, গোসলের সময় কানে যাতে পানি না যায়। এভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে এ সমস্যা সার্জারি ছাড়াই সেরে যায় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

আর যদি দীর্ঘদিনের ইনফেকশন হয় বা কানের পর্দা ছেঁড়া থাকে, তখন আগে ইনফেকশন সারিয়ে সার্জারি করতে হবে। তার আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে কানের ভেতরের হাড় ও টিস্যুর ক্ষয় হয়েছে কি না। যদি হয়, তাহলে বড় সার্জারি করতে হবে। না হলে শুধু কানের পর্দা জোড়া দিয়ে মরিঙ্গোপ্লাস্টি বা টেম্পানোপ্লাস্টি করলেই চলবে।
আবার দেখা যায়, অনেকের হঠাৎ করে শ্রবণশক্তি চলে যায়। ভাইরাল বা অন্য কোনো ইনফেকশন বা আঘাতজনিত কারণে এমনটি হয়। এ ক্ষেত্রেও জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ এ সমস্যা নিয়ে ৭ থেকে ১০ দিনের বেশি বসে থাকলে পরে চিকিৎসা করে কোনো লাভ হয় না।

প্রতীকী ছবি
ছবি: আগুঙ্গ পন্ডিত উইগুনা, পেকজেলসডটকম

অনুষ্ঠানে জন্মগত বধিরতা নিয়ে বেশ কিছু তথ্য দেওয়া হয়। এখন বাংলাদেশেই জন্মগত বধিরতার ভালো চিকিৎসা হচ্ছে। ঢাকায় জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউট, সিএমএইচসহ আরও কয়েকটি জায়গায় ককলারি ইমপ্ল্যান্ট হচ্ছে। যদিও এটি একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। তবে বিশেষজ্ঞ শোনালেন আশার কথা। বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এই চিকিৎসার ব্যয় কমানোর জন্য কাজ করছে। এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে অন্যান্য বড় হাসপাতালে এই চিকিৎসা শিগগির চালু করা হবে।

বধিরতার এই চিকিৎসা বা ককলারি ইমপ্ল্যান্ট অল্প বয়সে করাই উত্তম। দেখা যায়, শিশু যদি কানে না শোনে তাহলে তাকে সাধারণ শিশুবিশেষজ্ঞ বা মেডিসিন স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকে আবার ভাবেন যে বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। এ বধিরতার সমস্যা বড় হলে কখনোই ঠিক হয় না, এমনকি সে সময় চিকিৎসা করেও লাভ হয় না। তাই একদম শিশু অবস্থাতেই বধিরতার চিকিৎসা করতে হবে।

সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পর আমাদের শ্রবণশক্তি কমতে শুরু করে। বৃদ্ধ বয়সে গেলে দেখা যায় অনেকে কানে ঠিকমতো শোনেন না। বৃদ্ধ বয়সের এ ধরনের বধিরতার সমস্যার জন্য চিকিৎসকেরা ‘হিয়ারিং অ্যাইড’ ব্যবহার করতে বলেন।

আমাদের দেশে কানের চিকিৎসায় রোগীর ‘সার্জারি ভীতি’ খুব দেখা যায়। অনেকে মনে করেন, এখানে সার্জারি করলে শ্রবণশক্তি একেবারেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আশ্বস্ত করে বলেন, এখন বাংলাদেশেই দক্ষ চিকিৎসক দ্বারা স্বল্প খরচে নাক, কান ও গলার উন্নত চিকিৎসা ও সফল সার্জারি হচ্ছে।

অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ডা. সুব্রত ঘোষ দর্শকদের নাক, কান ও গলার বিভিন্ন সমস্যাসংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দেন।