পারকিনসনস রোগ প্রতিরোধে থাকতে হবে সচেতন

পারকিনসনস মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ। মস্তিষ্কের যে অংশ শরীরের নড়াচড়া ও ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, পারকিনসনস তাকে আক্রান্ত করে। রোগের লক্ষণ শুরুতে খুব একটা বোঝা না গেলেও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। ভয়ের কথা হলো, পারকিনসনস রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে ওষুধের মাধ্যমে কিছু কিছু লক্ষণ প্রশমিত করা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে মস্তিষ্কের আক্রান্ত অংশে সার্জারির মাধ্যমে সামান্য উন্নতি করা সম্ভব।

লক্ষণ

পারকিনসনস রোগের বিভিন্ন লক্ষণ আছে। তবে সব সময় এক রকম না–ও হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমস্যাগুলো দেহের একদিকে শুরু হয়, পরে দুপাশ আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগের অন্যতম লক্ষণগুলো হলো:

  • হাত বা হাতের আঙুল অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে থাকে। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির সঙ্গে তর্জনী ঘষলে এ ধরনের কাঁপুনি টের পাওয়া যায়।

  • ধীরে ধীরে নড়াচড়া করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। ফলে অনেক সহজ কাজ করা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। যেমন: হাঁটার সময় রোগীর পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য কমে যায়, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানো বা পোশাক বদলানো কঠিন হয়ে পড়ে।

  • শরীরের বিভিন্ন স্থানে মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে ব্যথা অনুভূত হয় এবং হাঁটাচলায় সমস্যা দেখা দেয়।

  • পারকিনসনসের ফলে চলাফেরা ও বসার অঙ্গভঙ্গি পরিবর্তিত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে রোগী ভারসাম্যহীনতায় ভোগে।

  • স্বাভাবিক কিছু গতিবিধি যেমন চোখের পাতা ফেলা, হাসা, এমনকি হাঁটার সময় দুই হাত নাড়ানোর ক্ষমতা হ্রাস পায়।

  • কথা জড়িয়ে আসা, কথা বলার আগে দ্বিধা, অনিয়ন্ত্রিতভাবে দ্রুত কথা বলা এ রোগের লক্ষণ।

  • রোগীর জন্য লেখালেখি করা কঠিন হয়ে পড়ে। লেখা আগের তুলনায় ছোট হয়ে যায়।

ঝুঁকি

পারকিনসনস যে কারোরই হতে পারে। তবে কিছু কিছু বিষয় এ রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন রোগটি মূলত মধ্যবয়সে অথবা বার্ধক্যে হয়ে থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পারকিনসনস রোগের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। নিকটাত্মীয় কারও পারকিনসনস থাকলে এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সাধারণত পুরুষদের পারকিনসনস বেশি হয়ে থাকে। আগাছা দমনের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক কিংবা কীটনাশক পারকিনসনস রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

জটিলতা

পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত হলে বেশ কিছু জটিলতা দেখা যায়। যেমন চিন্তাশক্তি কমে যায়, স্মৃতিভ্রম বা ডিমেনশিয়া হয়। শুরুর দিকে রোগী অবসাদগ্রস্ত হতে পারেন। এ ছাড়া কিছু আবেগের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। যেমন: ভয়, উদ্বেগ, কাজের প্রেরণা হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি।

জটিলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবার গিলতে সমস্যা দেখা দেয়। মুখে লালা জমতে শুরু করে এবং মুখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। পারকিনসনসের পরবর্তী ধাপে মুখের অনেক মাংসপেশি আক্রান্ত হয়ে খাওয়াদাওয়ার সমস্যা তৈরি হয়। অনেকেই ঘুমের সমস্যায় ভুগে থাকেন। অনেকেই মূত্রথলির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে অযাচিতভাবে মূত্রত্যাগ করে বসেন। অনেকেরই কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়।

রক্তচাপ কমে যাওয়ার ফলে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ানোর সময় মাথা ঘোরা বা ঝিমঝিম করতে পারে, যা অর্থোস্ট্যাটিক হাইপোটেনশন নামে পরিচিত।

চিকিৎসা

চিকিৎসায় পারকিনসনস সম্পূর্ণ সারে না। তবে ওষুধ, পুনর্বাসন, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এ রোগের কিছু লক্ষণ উপশম করা সম্ভব। বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।

কিছু ওষুধের মাধ্যমে মস্তিষ্কে ডোপামিনের পরিমাণ বাড়িয়ে হাঁটার সমস্যা, হাত, পা কাঁপা ইত্যাদি উপশম করা যায়।

দীর্ঘদিনের পারকিনসনস রোগী, যাঁদের রোগ খুব গুরুতর এবং যাঁরা কারবিডোপা-লেভোডোপা ওষুধে খুব ভালো ফল পাচ্ছেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন (ডিবিএস) দেওয়া যেতে পারে। এ সার্জারির মাধ্যমে ব্রেইনের নির্দিষ্ট অংশে ইলেকট্রোড স্থাপন করা হয়। এটি মস্তিষ্কে ইলেকট্রিক সিগন্যাল পাঠিয়ে পারকিনসনস রোগের চিকিৎসা করে।

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে পারকিনসনস রোগী অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করতে পারেন। এর মধ্যে আছে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। আঁশযুক্ত খাবার ও পর্যাপ্ত পানি খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হবে, যা পারকিনসনস রোগের একটি নিয়মিত সমস্যা। এ রোগে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার খেলে উপকার পাওয়া যায়। আবার শরীরচর্চা মাংসপেশির শক্তি, নমনীয়তা ও ভারসাম্য বৃদ্ধি করে। এর মাধ্যমে অবসন্নতা ও উদ্বেগ থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব। হাঁটাচলা, সাঁতার, বাগানচর্চা, হালকা ব্যায়াম পারকিনসনস রোগীর জন্য ভালো শরীরচর্চা। তবে পারকিনসনস রোগীর ভারসাম্য ও হাত–পা কাঁপার কারণে ব্যায়াম করা কঠিন হতে পারে।

আরও কিছু বিষয়:

  • পারকিনসনস রোগী খুব সহজেই পড়ে যায়। সামান্য ধাক্কাতেও রোগীর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পড়ে। এ জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর সময় পায়ের দিকে না ঝুঁকে শরীর সোজা রেখে ঘোরার চেষ্টা করতে হবে, শরীরের ভর দুই পায়ে সমানভাবে ন্যস্ত করতে হবে। কোনো দিকে ঝুঁকে দাঁড়ানো যাবে না। হাঁটার সময় কোনো কিছু বহন না করাই উত্তম। পেছন দিকে হাঁটা যাবে না।

  • দৈনন্দিন কাজ যেমন পোশাক পরা, খাওয়া, গোসল, লেখালেখির মতো কাজগুলো করা পারকিনসনস রোগীর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদের সাহায্য নিয়ে ধীরে ধীরে এসব কাজে অভ্যস্ত হতে হবে।

  • ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে পুনর্বাসন চিকিৎসা করে পারকিনসনস রোগে উপকার পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে হাঁটাচলা, কথা বলা ও খাবার খাওয়ার সমস্যা দূর করা সম্ভব।

  • যেকোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগই জীবনে জটিলতা সৃষ্টি করে। পারকিনসনস রোগীর অযাচিত রাগ, অবসাদ, নিরুৎসাহ, বিষণ্নতায় ভোগা খুবই স্বাভাবিক। এ রোগে আক্রান্ত হলে দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজগুলো করতেও সমস্যা তৈরি হয়, যা রোগীর জন্য অত্যন্ত অস্বস্তিকর। রোগীর অবসাদ ও বিষণ্নতা দূর করতে পরিবারের সমর্থনের পাশাপাশি অ্যান্টিডিপ্রেশেন্ট ওষুধ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

যেহেতু এ রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তাই পারকিনসনস রোগীর প্রতি সবার সহানুভূতিশীল হতে হবে। সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে।