পিত্ত যখন জমে পাথর

‘স্যার, রোগী আসছে!’

আমার চেম্বার সহকারীর কথা শেষ না হতেই দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন একজন ভদ্রমহিলা, সঙ্গে একজন পুরুষ অ্যাটেনডেন্ট।
তিনি তাঁর হাতে ধরা ফাইলগুলো আমাকে দিয়ে বললেন, ‘দেখেন তো স্যার, কী অবস্থা!’
আমি তাঁদের বসতে বলে ফাইলে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলাম। দেখতে পেলাম আলট্রাসাউন্ড রিপোর্টে লেখা আছে পিত্তপাথর।
আমি কিছু বলার আগেই ভদ্রমহিলা বললেন, ‘স্যার, আমি কিন্তু মেশিন দিয়ে অপারেশন করাব না।’
বললাম, ‘আচ্ছা! কেন?’
‘আমি শুনছি, মেশিন দিয়ে কাটলে পিত্ত পুরাটা আসে না। আবার হয়। আমাদের গ্রামে একজন করাইছিল। দুই মাস পরে তার আবার পিত্তপাথর হইছে।’

বললাম, ‘আচ্ছা! তাই নাকি! ধরেন আপনার একটা হাত আমি কবজি থেকে কেটে দিলাম। দুই মাস পরে এটা কি নতুন করে গজাবে?’
তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, ‘কী যে বলেন স্যার!’

‘পিত্তথলিও আসলে এ রকম। এটা একবার কেটে ফেললে আর গজাতে পারে না। তবে এমন হতে পারে যে অপারেশনের সময় ছোট কোনো পাথর পিত্তনালিতে চলে যেতে পারে। এ রকম ঘটনা কেটে করলে বা মেশিন দিয়ে করলে দুই ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। যদিও সেটা সচরাচর ঘটে না। তবে কেটে অপারেশনের চেয়ে মেশিনে করার সুবিধা বেশি। মেশিনে কাটা কম পড়ে, ব্যথা ও ভোগান্তি কম হয় আর সেফটি বেশি। সেই সঙ্গে অপারেশনের পরদিনই বাড়িতে গিয়ে মোটামুটি সব কাজ করা শুরু করতে পারবেন।’

পিত্তটা আসলে কী?
‘মাছ কাটা দেখছেন কখনো বা কেটেছেন?’
‘জি।’
‘মাছ কাটলে মাছের পিতটা ফেলে দিতে হয়। নইলে খেতে তিতা লাগে। মাছের কলিজার সঙ্গে লাগানো থাকে সেটা। মানুষেরটাও প্রায় একই রকম। কলিজার নিচে ছোট একটা থলিতে পিত এসে জমা হয়।’

এটার কাজ কী?
আমরা যখন চর্বিজাতীয় খাবার খাই, তখন এটা নিজের ভেতর জমে থাকা পিত্ত পেটের নাড়িতে পাঠায়, যেটা হজমে সাহায্য করে। তবে পিত্ত তৈরি হয় যকৃতে। তাই পিত্তথলি কেটে ফেললেও পিত্ত আসতে কোনো সমস্যা হয় না। শুধু আগে চর্বিজাতীয় খাবার খেলে একসঙ্গে বেশি পরিমাণে পিত্ত আসত, সে সুবিধাটুকু কমে যায়।

এটাতে পাথর কেন হয়? কাদের বেশি হয়?

পাথর হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে পিত্তরস কোনো কারণে ঘন হলেই পাথর হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। শরীরে চর্বি বেশি জমলে, পানি কম খেলে, রক্ত বেশি ভাঙলে, এ রকম পাথর জমতে পারে। মেডিকেলের বইতে লেখা আছে, পাঁচটি এফ থাকলে এ পাথর হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এগুলো হলো ফ্যাট, ফিমেল, ফেয়ার, ফার্টাইল আর ফোরটি।

মানে চল্লিশোর্ধ্ব ফরসা, স্বাস্থ্যবতী নারী ও যাঁদের বাচ্চা আছে, তাঁদের পিত্তপাথর হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

এ পাথর থাকলে কী কী সমস্যা হতে পারে?

পাথর থাকলেও যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে অপারেশন করা তেমন জরুরি না। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলে অপারেশন করে নেওয়া ভালো। সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা যায় যেটা, তা হলো বুকের ডান দিকে নিচের অংশে বা পেটের ওপরের অংশে মনে হয় যেন চাপ দিয়ে কিছু একটা ধরে আছে।

এর সঙ্গে গ্যাসের সমস্যা, বমি ভাব হতে পারে। অনেক সময় ব্যথাটা ডান কাঁধে বা পেছনের দিকেও যেতে পারে। ছোট পাথর অনেক সময় পিত্তনালিতে চলে আসতে পারে। তখন জন্ডিস, প্যানক্রিয়াটাইটিস এসব সমস্যাও হয়। সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসার নিয়ম কিছুটা পাল্টে যাবে।

সাধারণত রোগীরা বেশি যে সমস্যাটা নিয়ে আসেন তা হলো, ভারী খাবার, যেমন ফাস্ট ফুড, বিরিয়ানি, গরুর মাংস বা ভাজাপোড়া এসব খাবার খেলে একটু পরেই পেটে মোচড় দিয়ে ব্যথা করে। বারবার এ রকম হলে একজন চিকিৎসকতে দেখিয়ে নেওয়া জরুরি।

এটা কীভাবে ডায়াগনসিস করা যায়?
পোটের আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষাতেই এটা ধরা পড়ে। তবে সার্বিক অবস্থা বোঝার জন্য চিকিৎসক আপনাকে রক্ত ও লিভারের কিছু পরীক্ষা দিতে পারেন।

চিকিৎসা কী?

যদি অন্য কোনো রোগের পরীক্ষা করাতে গিয়ে পিত্তপাথর ধরা পড়ে, অর্থাৎ পিত্তপাথরজনিত কোনো কষ্ট না থাকে, তাহলে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে ভালো থাকা যায়। ভারী খাবার না খেলেই হলো।
কিন্তু যদি সিম্পটম বা কষ্ট থাকে, তাহলে অপারেশন করিয়ে নেওয়া ভালো।

পিত্তপাথর কি বাইরে থেকে গলানো যায় না?
গলানো যায়। কিন্তু পিত্তনালিতে সে পাথর আটকে গেলে বা আঘাত করলে সেখান থেকে ইনফেকশন, জন্ডিস বা প্যানক্রিয়াটাইটিসের মতো ক্ষতিকর রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সেটা করা হয় না।

এ অপারেশনের পরে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
সমস্যা খুব কমই হয়। প্রথম কিছুদিন খাবার হজমে সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু এরপর সেটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। পিত্তথলি আর পাথর না থাকায় পরে চর্বিজাতীয় খাবার খেলেও সে রকম পেটব্যথা করে না।

এ রোগ থেকে বেঁচে থাকার জন্য কী করা উচিত?
ভালো খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম আর পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।

ডা. রেজা আহমদ, সহকারী অধ্যাপক, জেনারেল ও ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন, সিলেট সেন্ট্রাল ডেন্টাল কলেজ, সিলেট