প্রতিদিন যতটুকু লবণ গ্রহণ করা উচিত

ছবি: পেকজেলসডটকম

লবণ আমাদের খাদ্যতালিকায় অপরিহার্য একটি উপাদান। প্রতিদিন কতটুকু লবণ আমাদের স্বাস্থ্যের ভারসাম্য বজায় রাখে, কতটুকু খেলে শরীরে নানা সমস্যা তৈরি করে—এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গাইডলাইন আছে। মানুষ যেন সেই গাইডলাইন মেনে চলতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের কারণে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সঠিক পরিমাপে লবণ গ্রহণ করলে প্রতিবছর ২৫ লাখ মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে বেঁচে যাবে বলে তারা আশা করে। এ জন্য এই সংস্থার দেওয়া গাইডলাইন মেনে চলতে তারা পরামর্শ দিয়ে থাকে।

রান্নায় লবণ কম হলে যেমন খাওয়া যায় না, তেমনই লবণ বেশি হলেও মুখে তোলা দায়। কম বা বেশি লবণ খাবারের স্বাদ একেবারেই নষ্ট করে দেয়, আবার পরিমাণমতো লবণ সেই খাবারকেই সুস্বাদু করে তোলে। লবণের মূল উপাদান সোডিয়াম ক্লোরাইড, আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, আমাদের শরীরে ঠিক কতটা লবণের প্রয়োজন, আমরা আমাদের খাদ্যাভ্যাসের দরুন না বুঝেই দৈনিক প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লবণ গ্রহণ করে ফেলি। অত্যধিক লবণ শরীরে বিভিন্ন প্রকার সমস্যা তৈরি করে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দৈনিক মাত্র পাঁচ গ্রাম লবণ গ্রহণ করার কথা বলছে। পাঁচ গ্রাম আসলে চা–চামচের সমান পরিমাণ।

ছবি: পেকজেলসডটকম

লবণ নিয়ে আমাদের কেউ প্রশ্ন করলেই আমরা সাফ বলে দিই আমি লবণ খাই না! কিন্তু আমাদের খাদ্যাভ্যাসই হচ্ছে লবণনির্ভর। ভাত, তরকারি, ডাল, শাক, মাছ, মাংস, ভর্তা সবকিছুতেই লবণ আধিক্য। এমনকি আমরা সালাদ, কাঁচা ফল লবণ দিয়ে খাই। সকালে নাশতা, বিকেলের নাশতা রুটি, পুরি, সমুচা, শিঙাড়া, বড়া, নুডলস সুপ সবই লবণে তৈরি। সব মিলিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন থেকে দুই থেকে তিন গুণ খেয়ে থাকি।

একটি পরিবারের চারজনের মাসে ১ কেজির বেশি লবণ লাগে অর্থাৎ প্রতিজন ২৫০-৩০০ গ্রাম, দৈনিক হিসাবে ৯-১০ গ্রাম লবণ গ্রহণ করি, যা গাইডলাইন থেকে দ্বিগুণ। আর যদি সপ্তাহান্তে পোলাও, বিরিয়ানি, হালিম, নুডলস খেয়ে থাকি, তাহলে লবণ গ্রহণের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। এটা অতি সাধারণ চিত্র আমাদের সব পরিবারে। আর ফাস্ট ফুডে লবণের পরিমাণ বেশি থাকার কারণে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। লবণের ভালো–মন্দ, লবণের গুণাগুণ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আমরা সবাই কি জানি? লবণ আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যের একটি অপরিহার্য অংশ।

ছবি: পেকজেলসডটকম

লবণ ছাড়া প্রায় প্রতিটি খাবারই অসম্পূর্ণ, লবণ যে শরীরকে শুধু হাইড্রেটেড রাখে তা নয়, থাইরয়েড গ্রন্থি যাতে সঠিকভাবে কাজ করে, তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, শুধু তা–ই নয়. ব্লাডপ্রেশার কম থাকলে বা শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ কমে গেলে লবণ বিশেষভাবে সাহায্য করে। এমনকি লবণের মাধ্যমেই শরীরে আয়োডিনের চাহিদা পূরণ হয়, দেহের মোট তরলের পরিমাণ, অ্যাসিড ও ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য এবং সাধারণ কোষের কার্যকারিতা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান।

লবণ খাবার নয়! এর রন্ধন সম্পর্কিত ব্যবহারের আর কোনো ন্যায়সঙ্গতা নেই। পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, বেরিয়াম ক্লোরাইডের চেয়ে বেশি বা ড্রাগজিস্টের অন্য কোনো রাসায়নিক। শরীরের দ্বারা লবণ হজম করা যায় না, লবণের নেই পুষ্টির মূল্য! লবণের কোনো ভিটামিন নেই, জৈব খনিজ নেই! পরিবর্তে, এটি ক্ষতিকারক এবং এতে সমস্যা সৃষ্টি করে কিডনি, মূত্রাশয়, হার্ট, ধমনি, শিরা ও রক্তনালিগুলো।

ছবি: পেকজেলসডটকম

লবণে জলাবদ্ধ হয়ে টিস্যুগুলোর ফোলা ভাব এবং এডিমা সৃষ্টি করে। লবণ গুরুতর চিকিৎসা সমস্যা সৃষ্টি করে এবং হার্টের বিষ হিসেবে কাজ করতে পারে। এটা স্নায়ুতন্ত্রকেও জ্বালাতন করে। লবণ শরীর, হাড় ইত্যাদি থেকে ক্যালসিয়াম ছিনিয়ে নেওয়ার কাজ করে এবং শ্লেষ্মা আক্রমণ করে শরীরজুড়ে আস্তরণ তৈরি করে। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর। গবেষণায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করলে নানা ধরনের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যেমন: হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড, স্নায়ুর সমস্যা, কিডনি সমস্যা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

মানুষ বুঝে ওঠার আগেই অনেক ক্ষতি হয়ে যায়, ইদানীং লক্ষ করবেন যে আমাদের আশপাশে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কিডনি রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগী তো ঘরে ঘরে, যার ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়ে।
দৈনিক লবণ গ্রহণের পরিমাণ কমানো উচিত কেন? অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ, মূলত লবণের মাধ্যমে এবং অপর্যাপ্ত পটাশিয়াম গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী।

ছবি: পেকজেলসডটকম

গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে দৈনিক পাঁচ গ্রামের কম লবণ গ্রহণ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, স্ট্রোক, কিডনির সমস্যা, হার্ট অ্যাটাক প্রভৃতির ঝুঁকি কমায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বেশির ভাগ মানুষই প্রতিদিন গড়ে ৯-১২ গ্রাম লবণ গ্রহণ করে, যদি বিশ্বব্যাপী লবণ গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়, তাহলে বছরে আনুমানিক ২৫ লাখ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হতে পারে।

নতুন গাইডলাইন কেন? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী লবণ গ্রহণের পরিমাণ ৩০ শতাংশ হ্রাস করার জন্য বলা হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে প্রক্রিয়াজাত খাবারের ব্যবহার প্রতিদিনের সোডিয়াম গ্রহণের পরিমাণ দ্রুত বাড়াচ্ছে। এই নতুন গাইডলাইন, সব দেশের বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলোতে সোডিয়াম হ্রাস করার জন্য নির্দেশিকা দেবে। প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্রমবর্ধমান উৎপাদন, দ্রুত নগরায়ণ ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনগুলো খাদ্যতালিকা রূপান্তরে সহায়তা করছে।

ছবি: পেকজেলসডটকম

বিশ্বজুড়ে মানুষ বেশি পরিমাণে শক্তি-ঘন খাবার গ্রহণ করে, যা স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট, চিনি ও লবণের পরিমাণ বেশি। লবণ সোডিয়ামের প্রাথমিক উৎস এবং সোডিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে যুক্ত এবং কিডনি, হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত।

খাদ্যতালিকায় লবণ বেশি আছে এমন প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ না করার জন্য বলা হয়েছে। কারণ, সেগুলোতে বিশেষত লবণ বেশি থাকে (যেমন প্রস্তুত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন বেকন, হ্যাম ও সালামি, পনির, নোনতা খাবার এবং ইনস্ট্রান নুডলস, বড় পরিমাণে প্রায়ই খাওয়া হয়, রুটি ও প্রক্রিয়াজাত সিরিয়াল পণ্য। রান্নার সময় টেবিলে সয়া সস, ফিশ সস ও টেবিল লবণ।

ছবি: পেকজেলসডটকম

কৌশল করে লবণ গ্রহণের মাত্রা কমানো যেতে পারে, বিশেষ করে সকালে নাশতা যদি ফল দিয়ে করা যায়, সে ক্ষেত্রে কমে গেল, দ্বিতীয়ত, দুপুরে ও রাতে যদি খাওয়ার সঙ্গে অর্ধেক সালাদ খাওয়ার অভ্যাস করা যায়, তাহলে লবণ কমে যাবে। তাতে শরীর ভালো থাকবে এবং লবণের দ্বারা যে ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তা–ও কমে আসবে।

লেখক: খাদ্য পথ্য ও আকুপ্রেসার বিশেষজ্ঞ।