সাক্ষাৎকার
প্রতিস্থাপিত কিডনির সঠিক যত্ন নিলে ১৫-২০ বছর কোনো সমস্যা ছাড়াই সেবা দেবে
হাজারের বেশি সফল কিডনি প্রতিস্থাপন করে সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। দরিদ্র কিডনি রোগীদের কিডনি প্রতিস্থাপন ও মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল। কিডনি প্রতিস্থাপনের নানা দিক নিয়ে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন ডা. মো. শরীফুল ইসলাম
প্রশ্ন :
কিডনি বিকল হয়ে গেলে চিকিৎসা কী?
কিডনি বিকলের শেষ ধাপে পৌঁছে গেলে বেঁচে থাকার জন্য নিয়মিত ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় থাকে না। নিয়মিত ডায়ালাইসিস ব্যয়বহুল ব্যাপার এবং সময়সাপেক্ষও। অনেকে আবার করাতে আগ্রহীও হন না। সে ক্ষেত্রে কিডনি প্রতিস্থাপন ভালো উপায়। সফল প্রতিস্থাপন করা গেলে এবং নিয়মমাফিক জীবনযাপন করলে পরবর্তী সময়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়।
প্রশ্ন :
যেকোনো বয়সেই কি কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব?
সাধারণ কম বয়সী বা তরুণদের কিডনি চিকিৎসায় প্রতিস্থাপনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ, তাঁদের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপনের সফলতা বেশি এবং তাঁদের সামনে ভবিষ্যৎ বিদ্যমান। ৬০ বছরের বেশি বয়স্কদের সাধারণত নিরুৎসাহিত করা হয়। ৭০-এর বেশি বয়সীদের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় না। কারণ, তাঁদের মধ্যে সফলতার হার কম। তাঁদের ডায়ালাইসিসের পরামর্শই দেওয়া হয়।
আমার প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৮টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, দাতাদের একজনেরও কিডনিজনিত কোনো সমস্যা হয়নি
প্রশ্ন :
কিডনিদাতা পাওয়াও তো একটি বড় সমস্যা!
কিডনি সংযোজন দুইভাবে করা যায়। একটি হলো নিকটাত্মীয়, যেমন মা-বাবা, ভাইবোন, চাচা-মামা, ফুফু-খালা; এমনকি চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, খালাতো ভাই, নানা-নানি, দাদা-দাদি, স্বামী-স্ত্রী। যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে এবং যাঁদের দুটি কিডনি সুস্থ, ডায়াবেটিস নেই, উচ্চ রক্তচাপ নেই, কিডনিতে কোনো অসুখ নেই, অন্যান্য রোগের কারণেও কিডনি আক্রান্ত নয়, তাঁরা স্বাভাবিক অবস্থায় স্বেচ্ছায় আত্মীয়কে কিডনি দিতে পারেন।
এ ছাড়া আরেকটি উপায় হলো মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি। শুধু দুটি কিডনি নয়, একটি মরদেহ থেকে লিভার, হৃৎপিণ্ড, দুটি ফুসফুসও অন্যকে দান করা যায়; অর্থাৎ একজন মৃত ব্যক্তি ৮-১০ জন মানুষকে পুনর্জীবন দিতে পারেন। তাঁদের বয়সও ৫ থেকে ৬৫ হতে হবে। দাতাদের ক্ষেত্রে দুটি কিডনি সুস্থ থাকতে হবে। বাড়িতে বা হাসপাতালের সাধারণ বিছানায় অথবা সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে রাস্তাতেই মারা গেলে সেই কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গ কিন্তু কাজে আসে না। যার অঙ্গ নেওয়া হবে, তাঁকে মৃত ঘোষণা করতে হবে আইসিইউতে বা নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে। যখন আইসিইউতে থাকা ব্রেন ডেড রোগীদের মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু অন্যান্য অঙ্গ তখনো কৃত্রিম উপায়ে কার্যকর থাকে, তখন অনুমতি পেলে আইন অনুযায়ী সেই ব্যক্তির অঙ্গ নিয়ে অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। যদিও আমরা এ ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি করতে পারিনি। উন্নত বিশ্বে ৮০-৯০ শতাংশ কিডনি এভাবেই প্রতিস্থাপন করা হয়। এই জন্য আমাদের ডোনার সংকট এত বেশি।
আরেকটি উপায় হলো অঙ্গ বিনিময় বা অর্গান সোয়াপিং পদ্ধতি। একটি পরিবারের কারও কিডনি দরকার কিন্তু তার পরিবারের যিনি দিতে আগ্রহী, তাঁরটা ম্যাচ হচ্ছে না। আবার আরেক রোগীর পরিবারের কারও কিডনি দরকার, যাঁর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তখন এই দুই রোগীর পরিবার ফেয়ার ডোনেশনের ভিত্তিতে কিডনি আদান-প্রদান করতে পারে। বিষয়টি যদি আইনে অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করা যায়, তাহলে কিডনি প্রতিস্থাপনের পরিসর আরও বাড়বে।
প্রশ্ন :
দেশে কিডনি দিতে অনীহা কাজ করে, এখানে কী ধরনের বাধা কাজ করে সাধারণত?
কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দাতা ও গ্রহীতার এইচএলএ (হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন) ম্যাচিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা পরিবারের বা নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই সাধারণত বেশি ম্যাচ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে ক্ষেত্রে কিডনি প্রতিস্থাপনের পর দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর থাকার সম্ভাবনাও বেশি। তাই অন্য সব ম্যাচিং হলে নিজেদের মধ্যে দেওয়া গেলে সেটাই মঙ্গলজনক। আর কিডনি দানের ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই।
প্রশ্ন :
যিনি কিডনি দান করছেন, তাঁর কোনো সমস্যা হয় কি না?
সাধারণত কোনো সমস্যা হয় না, বরং তাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে বেশি ভালো থাকেন বলে আমার পর্যবেক্ষণ। কারণ, তাঁরা প্রথম থেকে স্বাস্থ্যসচেতন জীবন যাপন করেন। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে থাকেন। আমরাও এখানে তাঁদের জন্য সারা জীবন ফ্রি ফলোআপের ব্যবস্থা রাখছি। আমার প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৮টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, দাতাদের একজনেরও কিডনিজনিত কোনো সমস্যা হয়নি।
প্রশ্ন :
কিডনি প্রতিস্থাপনের খরচ তো অনেক, সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে এটিকে সহজলভ্য করা যায় কি না?
নিয়মিত ডায়ালাইসিসের চেয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন ব্যয় কম ও ঝামেলাহীন বলা যায়। তারপরও যে খরচ পড়ে, তা অনেকের সামর্থ্যের বাইরে। আমাদের এখানে ২ লাখ ১০ হাজার টাকায় আমরা প্রতিস্থাপন করে থাকি। অন্যান্য জায়গায় একটু বেশি। বহির্বিশ্বে বা পার্শ্ববর্তী দেশে গেলে খরচ পড়ে ১০-২০ লাখ টাকা। যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার খরচ তো আছেই। সেই তুলনায় বলা যায়, আমাদের দেশে খরচ অনেক কম। আর সরকার বা সমাজের অনেক দানবীর মানুষ এগিয়ে এলে খরচ আরও কমানো যেতে পারে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য টানা দীর্ঘ সময় লাগে আবার প্রতিস্থাপন-পরবর্তী সময়ও লাগে অনেক। তাই সরকারি হাসপাতালে এমন বড় কাজ করতে গেলে ডেডিকেটেড প্রশিক্ষিত টিম তৈরি করতে হবে। যে টিমের কাজই হবে শুধু প্রতিস্থাপন করা। কিছুদিন পরপর তাদের বদলি করে দিলে তারা কাজ ঠিকমতো করতে পারবে না। আবার এমন দীর্ঘ অস্ত্রোপচার এবং অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ফলোআপের জন্য সেই ডেডিকেটেড টিমকে বিশেষ সম্মানী দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। তাহলে তারা উৎসাহিত হবে।
প্রশ্ন :
কিডনি প্রতিস্থাপন-পরবর্তী যত্ন কেমন হওয়া উচিত? কত দিন প্রতিস্থাপিত কিডনি কার্যকর থাকে? একাধিকবার কি কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়?
কিডনি প্রতিস্থাপন পরবর্তী যত্নের ওপর নির্ভর করে তা কত দিন কার্যকর থাকবে। তাই প্রতিস্থাপন-পরবর্তী যত্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত শৃঙ্খলার সঙ্গে ওষুধ সেবন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ অন্যান্য রোগ, যা কিডনিকে দুর্বল করতে পারে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা ও নিয়মিত ফলোআপ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাবারে পরিমিত লবণ, পরিমিত পানি পান ও চিন্তামুক্ত জীবন যাপন করা; নিয়মিত মাস্ক পরা, বেশি ভিড় এড়িয়ে চলা ও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। কিডনি প্রতিস্থাপিত রোগীর ডায়রিয়া বা পানিশূন্যতা হলে দ্রুততার সঙ্গে সঠিকভাবে তাঁর চিকিৎসা করতে হবে। সংক্রমণ যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফুসফুসের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য মাস্ক পরতে হবে। পেটের সংক্রমণ প্রতিরোধে বাইরের দূষিত খাবার, অপরিশোধিত পানি, বাসি-পচা খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
প্রতিস্থাপিত কিডনির সঠিক যত্ন নিলে ১৫-২০ বছর কোনো সমস্যা ছাড়াই সেবা দেবে। হ্যাঁ, একাধিকবার কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়। বিশ্বে এখন পর্যন্ত একজনের দেহে পাঁচবার সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করা গেছে। আমার প্রতিষ্ঠান সিকেডিতে এখন পর্যন্ত একজনের দ্বিতীয়বার কিডনি প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা প্রয়োজনে তৃতীয়বারও করার চেষ্টা করব।