বাংলাদেশে মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসারে মৃত্যুহার বেশি

বিশ্বব্যাপী মরণব্যাধিগুলোর মধ্যে ক্যানসার অন্যতম। বাংলাদেশেও এটি মৃত্যুহারের জন্য দায়ী রোগগুলোর তালিকায় রয়েছে। তাই ক্যানসার যাতে প্রাথমিক পর্যায়েই প্রতিরোধ করা যায়, সে জন্য এর উপসর্গ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখতে হবে। তবে আশার কথা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করলে জটিলতা এড়ানো যায়। এর মধ্যে কিছু রয়েছে যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, আবার কিছু রয়েছে যেগুলো আমরা জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিবর্তন করতে পারি। এর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। আর নিয়মমাফিক চলাফেরার মাধ্যমে ক্যানসার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসকেএফ অনকোলজি আয়োজন করছে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’। অনুষ্ঠানের ২৬তম পর্বে অতিথি ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন, সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও কো-অর্ডিনেটর, অনকোলজি বিভাগ, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড; প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, অনকোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ এবং ডা. এস এম আনোয়ার সাদাত, সহযোগী অধ্যাপক, কনসালট্যান্ট, ডেন্টাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড।

ডা. মো. শাহরিয়ার ইসলামের সঞ্চলনায় অতিথি ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন (নিচে) ও ডা. এস এম আনোয়ার সাদাত (উপরে ডানে)

এ পর্বের আলোচনার বিষয় ছিল: মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার। অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে সম্প্রচারিত হয়। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন ডা. মো. শাহরিয়ার ইসলাম।

ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, মুখ ও মুখগহ্বরের মধ্যে শুরুতেই আমরা ঠোঁট দেখতে পাই। তারপর মুখের ভেতরে রয়েছে মাড়ি, পাশে রয়েছে গাল, ওপরে তালু, তার পেছনে টনসিল, তার পেছনে রয়েছে ফ্যারিংস। এ ছাড়া জিহ্বা ও দাঁত খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আবার কিছু কিছু গ্ল্যান্ডসও আছে। অর্থাৎ সব মিলে খুব ছোট ছোট অনেকগুলো অংশ নিয়ে মুখ ও মুখগহ্বর গঠিত।

ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন

সারা বিশ্বে প্রতিবছর বহু মানুষ মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রায় ৩ লাখ ৫৫ হাজার জন এ রোগে আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ১ লাখ ৭৭ হাজার রোগী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১২.৫% পুরুষ ও ৬%-৭% নারী এ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ শনাক্ত করা গেলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসারের কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে। এ ক্যানসারে আক্রান্তের অন্যতম প্রধান কারণ তামাকের ব্যবহার। ধূমপান থেকে শুরু করে জর্দা, সাদা পাতা, গুল কিংবা তামাকজাতীয় অন্যান্য দ্রব্য সেবনের কারণে অধিকাংশ লোক এ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়।

প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সেবনের সঙ্গে ক্যানসারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আর এর সঙ্গে যদি মদ্যপান বা অ্যালকোহল জাতীয় দ্রব্য সেবন করা হয় তবে ক্যানসারের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এ ছাড়া হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস নামে একধরনের ভাইরাস আছে, বিশেষ করে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ১৬-র কারণে এটি হতে পারে। এ ছাড়া স্টেমসেল ট্রান্স প্ল্যান্টেশনের কারণেও এ রোগের ঝুঁকি অনেকাংশেই বেড়ে যায়। মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রাথমিকভাবে প্রত্যেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের ভেতরে আঙুল দিয়ে নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারে। এভাবে সচেতনতার মাধ্যমে এর ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

ডা. এস এম আনোয়ার সাদাত বলেন, মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসারের লক্ষণগুলোর ক্ষেত্রে প্রথমেই খেয়াল রাখতে হবে মুখের যেকোনো অংশ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যাচ্ছে কি না। আবার মুখের কোনো অংশে ঘা বা একটি ছোট পিণ্ডর মতো কিছু অনুভূত হওয়া, সাদাটে বা লাল হয়ে যাওয়া কিংবা রং পরিবর্তন হওয়া মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসারের লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম। আবার অনেক সময় মুখের ভেতরের সে নির্দিষ্ট স্থানে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যায় সে স্থানটি খসখসে অনুভূত হচ্ছে।

ডা. এস এম আনোয়ার সাদাত

অনেক ক্ষেত্রে মাড়ির কোনো অংশ থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ, মাড়ি নিচের দিকে দেবে যাওয়া কিংবা অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠতে পারে। এ ক্যানসারের প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যথা থাকে না। তাই অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে ব্যথা নেই বলে অবহেলা করা যাবে না। বরং দ্রুত অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঘা বেড়ে গেলে মুখে অস্বাভাবিক রকম বেশি লালা তৈরি হওয়া, মুখের ‘হাঁ’ ছোট হয়ে যাওয়া, জিহ্বা নাড়তে কষ্ট হওয়া এবং খেতে কষ্ট হতে পারে। অর্থাৎ মুখে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলেই দেরি না করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, পান, সুপারি, জর্দা এবং ধূমপানই মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসারের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। আবার পুষ্টিহীনতা এবং মুখের অভ্যন্তরের অনুপযুক্ত পরিবেশও এ রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া অপরিচ্ছন্নতার কারণেও এ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই পান, সুপারি, তামাক বা এ–জাতীয় দ্রব্য সেবনের বদভ্যাস ত্যাগ করে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ ও অন্যান্য সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া প্রতিদিন দুবেলা যত্নসহকারে দাঁত মেজে পরিষ্কারের মাধ্যমে এ রোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়।

ক্যানসারের ঝুঁকির কারণগুলো জানা থাকলে আমরা সচেতন হতে পারব। ফলে এর ঝুঁকি থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেতে পারব। বলা যেতে পারে, বর্তমানে বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার ধরন আগের চেয়ে অনেক উন্নত এবং এখানে বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব।