বিশ্বে কি নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি অসুখ-বিসুখে ভোগেন? উত্তরটা হলো, হ্যাঁ। তার একটা বড় কারণ নারীর শরীরের কাঠামোর ভিন্নতা; জীবনের নানা পর্যায়ে (গর্ভাবস্থা, স্তন্যদান, ঋতুচক্র ও রজঃনিবৃত্তির কালে) নানা শারীরিক পরিবর্তন। এসবের বাইরে একটা বড় কারণ হলো, নিজের শরীর-স্বাস্থ্য বিষয়ে মেয়েদের অসচেতনতা, চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবহেলা। হেলথউইকি বলছে, নারী-পুরুষ উভয়েই যক্ষ্মা রোগে সমানভাবে আক্রান্ত হলেও নারীদের মৃত্যু ও জটিলতার হার বেশি। প্রতিদিন বিশ্বে ৩০০ নারী যক্ষ্মার কারণে মারা যাচ্ছেন, কারণ তাঁদের এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসাসেবাই পাননি। অপুষ্টি আর রক্তশূন্যতার হার বিশ্বজুড়ে নারীদের মধ্যেই বেশি। কারণ, বারবার গর্ভধারণ, পরিবারে নারীদের কম গুরুত্ব, কম খাবার গ্রহণ ইত্যাদি।
কম খেলেও মেয়েদের চলে?
‘মেয়েদের শারীরিক গঠন পুরুষদের মতো সুঠাম ও পেশিবহুল হবে না। তাই মেয়েদের বেশি প্রোটিন খাবার দরকার নেই।’ এমন ধারণা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এখনো রয়ে গেছে। কথাটা ঠিক নয়। ‘ডায়েটারি গাইডলাইন অব আমেরিকা’ বলছে, ১৩ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীর প্রোটিনের চাহিদা সমান—দৈনিক প্রায় ৩৪ মিলিগ্রাম। তাই মাছ-মাংসের বড় টুকরো, দুধ-ডিম ছেলেমেয়ে-নির্বিশেষে সমানভাবে প্রয়োজন। বরং কিছু খনিজ উপাদান ও ভিটামিনের চাহিদা মেয়েদের বেশি। একটি কিশোরীর দৈনিক ১৫ মিলিগ্রাম আয়রন খেতে হবে, কিশোরের লাগবে ১১ মিলিগ্রাম। গর্ভধারণ ও স্তন্যদানের সময় প্রোটিন ও খনিজের চাহিদা আরও বেশি থাকে। অল্প বয়সে যথেষ্ট ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি গ্রহণ না করার কারণে পরবর্তী জীবনে মেয়েরা হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিসে ভোগে বেশি। তাই দুধের পেয়ালা রোজ মেয়েটিরও চাই। ভিটামিন ডি আছে সূর্যালোকে। মেয়েদের তাই বাইরে খেলাধুলাও করা দরকার। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, স্ট্রোকের হার নারী-পুরুষ উভয়ের প্রায় সমান। এগুলো ঠেকাতে নিয়মিত ব্যায়াম, হাঁটা, জগিং নারীদেরও আবশ্যিক।
যত্ন চাই বিশেষ সময়ে
প্রতি মিনিটে বিশ্বে একজন নারী মারা যাচ্ছেন গর্ভকালীন জটিলতায়। প্রতিবছর ৭০ হাজার মেয়ের মৃত্যু হয় অনিরাপদ গর্ভপাত করতে গিয়ে। উন্নয়নশীল দেশে এক-চতুর্থাংশ নারী গর্ভকালীন নানা জটিলতা, সংক্রমণ, অধিক রক্তপাত ইত্যাদি জটিলতায় ভোগেন। বাল্যবিবাহ, ঘন ঘন গর্ভধারণ, অনিরাপদ প্রসব এসব জটিলতার জন্য দায়ী। তাই বয়স ১৮ হওয়ার আগে কিছুতেই বিয়ে নয়, দুটি সন্তানের মধ্যে ফারাক থাকবে দুই বছর। আর গর্ভকালীন পুষ্টি, সেবা ও নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করতে হবে সবার জন্য।
বিষণ্নতা, কাজের চাপ
নারীরা বিষণ্নতায় তুলনামূলক বেশি ভোগেন। বাংলাদেশে নারীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। মানসিক সমস্যাকে আমলে নেওয়ার মতো মানসিকতা মেয়েদের মধ্যে এখনো তৈরি হয়নি। এর বাইরেও আছে নারীর প্রতি সহিংসতা, গৃহকর্মে নানা দুর্ঘটনা, মেয়েলি সমস্যা প্রকাশে জড়তা প্রভৃতি। সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে নারীস্বাস্থ্যের প্রতি তিনটি বড় হুমকিকে চিহ্নিত করেছেন গবেষকেরা—অপুষ্টি, গর্ভধারণজনিত জটিলতা ও অত্যধিক কাজের চাপ। এই দুষ্ট বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে মেয়েদের, পরিবারকেও।
ডা. তানজিনা হোসেন
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ