বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে

বিশ্বব্যাপী মরণব্যাধিগুলোর মধ্যে ক্যানসার অন্যতম। বাংলাদেশেও এটি মৃত্যুহারের জন্য দায়ী রোগগুলোর তালিকায় রয়েছে। তাই ক্যানসার যাতে প্রাথমিক পর্যায়েই প্রতিরোধ করা যায়, সে জন্য এর উপসর্গ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখতে হবে। তবে আশার কথা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করলে জটিলতা এড়ানো যায়। অর্থাৎ ক্যানসার পুরোপুরিভাবে প্রতিরোধ করা না গেলেও এর ঝুঁকির কারণগুলো জানা থাকলে আমরা সচেতন হতে সক্ষম হব। ফলে এর ঝুঁকি থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেতে পারব।

এর মধ্যে কিছু রয়েছে, যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই; আবার কিছু রয়েছে, যেগুলো আমরা জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিবর্তন করতে পারি। আর এর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং নিয়মমাফিক চলাফেরার মাধ্যমে ক্যানসার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবস উপলক্ষে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ অনুষ্ঠানের বিশেষ পর্বের আয়োজন করা হয়।

এসকেএফ অনকোলজি নিবেদিত এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগ দেন অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন, সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও কো-অর্ডিনেটর, অনকোলজি বিভাগ, স্কয়ার হাসপাতাল এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, অনকোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ; ডা. আলী আসগর চৌধুরী, এমবিবিএস, এফসিপিএস, ক্যানসার বিশেষজ্ঞ (ক্লিনিক্যাল অনকোলজিস্ট) ও সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল; ডা. মোহাম্মদ এস্তেফছার হোছাইন, এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), এমফিল (রেডিওথেরাপি), সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল; ডা. মো. মহসীন হাওলাদার, রেডিওথেরাপি বিভাগ, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল; ডা. সাদিয়া শারমিন, সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সঞ্চালক ডা. মো. শাহরিয়ার ইসলাম

অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজে সম্প্রচারিত হয়। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন ডা. মো. শাহরিয়ার ইসলাম।

অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, আমরা জানি, ইউআইসিসি ৪ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব ক্যানসার দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমাদের দেশেও এটি পালিত হচ্ছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ ক্যানসারে ভুগছে। এটি এমন একটি রোগ, যার কারণে প্রতিবছর প্রায় ৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে এবং এর মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগই আমাদের মতো দেশের মানুষ। এর পেছনে বহু কারণ থাকতে পারে।

অংশগ্রহণকারী ক্যানসার বিশেষজ্ঞগণ

খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে ধূমপান বা মদ্যপান কিংবা ব্যায়ামের অভাবেও এ ধরনের রোগের ঝুঁকি বাড়ে। এমনকি শুধু তামাকই সারা পৃথিবীতে ২২ শতাংশ মানুষের মৃত্যুর কারণ।

এ ছাড়া আমাদের দেশের প্রায় ২৬ শতাংশ মানুষ চিকিৎসার সুব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। আমাদের দেশেও ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে এটি ২০ লাখের বেশি। আমাদের দেশে তামাকজনিত ক্যানসারগুলোতে পুরুষেরা বেশি আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া খাদ্যনালি ও কোলন ক্যানসারেও পুরুষেরা বেশি আক্রান্ত হয়। প্রোস্টেট ক্যানসার তুলনামূলকভাবে কম হয়। আর নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসার, জরায়ু মুখের ক্যানসার, খাদ্যনালি, কোলন ক্যানসার, ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে আজকাল নারীদের ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। আর নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই নাক-কান-গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়ে চলেছে।

ডা. সাদিয়া শারমিন বলেন, অনেক ক্যানসারেরই কারণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার কিছু কিছু ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে খুব সাধারণ কিছু কারণ রয়েছে, যেমন ধূমপান কিংবা তামাকজাত দ্রব্য সেবন। নাক-কান-গলা এবং ফুসফুস ক্যানসারের পেছনে একেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়। এর সঙ্গে মূত্রথলির ক্যানসারেরও কিছু সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের দেশের নারীদের জরায়ু মুখের ক্যানসার ও স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। এর জন্য হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসকে দায়ী করা হয়। এ ছাড়া খুব কম বয়সে বিয়ে করা বা খুব কম বয়সে সন্তানসম্ভবা হওয়া কিংবা অপরিচ্ছন্ন থাকা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আবার স্তন ও কোলন ক্যানসারের ক্ষেত্রে জেনেটিক কারণের প্রভাব খুব বেশি।

ডা. মোহাম্মদ এস্তেফছার হোছাইন বলেন, ক্যানসার থেকে নিরাপদে থাকতে হলে এর উপসর্গগুলো জেনে নেওয়া খুবই জরুরি। ক্যানসারের প্রাথমিক স্তরে যেসব উপসর্গ দেখা দেয়, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মল বা মূত্রের সঙ্গে রক্ত আসা, শরীরের কোনো ক্ষত স্থান থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ, সময়ের সঙ্গে ক্ষতস্থানের উন্নতির বদলে অবনতি হওয়া, মলের রঙের পরিবর্তন, ডায়রিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়া, শরীরের কোনো অংশ যেমন স্তন, অণ্ডকোষ কিংবা অন্য কোনো স্থানে গোটা কিংবা চাকার উপস্থিতি এবং শরীরের আঁচিল বা তিলের অবস্থার হঠাৎ পরিবর্তন বা বেড়ে যাওয়া। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি কাশি, কণ্ঠস্বর ভেঙে যাওয়া, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, গলা কিংবা বুকে চাপ, ওজন কমে যাওয়া ও ক্ষুধামন্দ্য হতে পারে।

ডা. মো. মহসীন হাওলাদার বলেন, আমাদের দেশের অন্যান্য অঞ্চলের রোগীর রিপোর্টের সঙ্গে বরিশাল অঞ্চলের মিল রয়েছে। আমরা সাধারণত নাক-কান-গলার ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীই বেশি পেয়ে থাকি। পুরুষ এবং নারী উভয়েই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন এবং প্রায় ২০ ভাগ রোগী এতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। নারীরা সাধারণত স্তন ক্যানসারে এবং পুরুষেরা সাধারণত ফুসফুস ক্যানসারে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। গত বছরের হিসাব একটি ব্যতিক্রম। এ হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১৪ শতাংশ রোগী স্তন ক্যানসারে, প্রায় ১০ শতাংশ রোগী নাক-কান-গলার ক্যানসারে এবং প্রায় ১০ শতাংশ রোগী ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। সাধারণত ক্যানসার চিকিৎসার তিনটি উপায় আছে, সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি।

ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ক্যানসার চিকিৎসায় অনেক দূর এগিয়েছে। এতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন আমাদের দেশের স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞরা। এর পেছনে ওষুধ কোম্পানিগুলোর অবদানও অনেক। তারা স্বল্প মূল্যে অনেক কার্যকরী ওষুধ বাজারজাতকরণের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি হাসপাতালও গড়ে উঠেছে। তবে আমাদের দেশে অল্প বয়সী রোগীর সংখ্যা বেড়েছে এবং তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি রোগীর বয়স ৫০ বছরের নিচে, যা আমাদের জন্য একটি বড় হুমকি। এ বিষয় আমাদের আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।

ক্যানসারযোদ্ধা ডা. ফারহানা রিজওয়ানা বলেন, ডায়াগনসিস সেক্টরের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আরও উন্নত ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। এখানে আরও বেশি অনকোলজিস্ট প্রয়োজন। পাশাপাশি অ্যান্টিক্যানসার ড্রাগসের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে। ক্যানসার চিকিৎসা যেহেতু খুব ব্যয়বহুল, তাই এ বিষয়ে কিছুটা গুরুত্ব দিতে হবে। আশার কথা এই যে বর্তমানে বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার ধরন আগের চেয়ে অনেক উন্নত এবং এখানে বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসার সুব্যবস্থাও রয়েছে।