‘বৃদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই হাড়ের যত্ন নেওয়া উচিত’

দুর্ঘটনায় হাড় ভেঙে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু কেমন হবে? বয়স্ক মানুষের হাড়ের যত্নে কী কী মানতে হবে? হাড় ভাঙার কারণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা-সম্পর্কিত বিবিধ প্রশ্নের উত্তর দিলেন আন্তর্জাতিক অর্থোপেডিক সোসাইটির পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি ও সার্ক কান্ট্রি অব অর্থোপেডিক সোসাইটির সভাপতি এবং অর্থোপেডিক ও অর্থোপ্লাস্টি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডা. শরিফুল ইসলাম

বাংলাদেশে হাড় ভাঙার প্রধান কারণ কী?

বাংলাদেশে হাড় ভাঙার অন্যতম কারণ হলো দুর্ঘটনা—যার মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি সড়ক দুর্ঘটনা। এ ছাড়া গাছ বা উঁচু দালান থেকে পড়ে যাওয়া, কলকারখানার দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে হাড় ভাঙতে পারে। বয়সজনিত বা হাড় ক্ষয়জনিত কারণেও অনেক সময় হাড় ভাঙতে পারে। দুর্ঘটনাজনিত হাড় ভাঙা সাধারণত দুই ধরনের হতে পারে—শুধু হাড় ভাঙা এবং হাড় ভাঙা ও তার আশপাশের সফট টিস্যু বা মাংসপেশিসহ ইনজুরি বা ক্ষত। দুই ধরনের ভাঙাতেই প্রাথমিক সাবধানতা ও শুরুর চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

হাড় ভেঙে গেলে প্রাথমিক করণীয় কী?

শরীরের কোথাও কোনো হাড় ভেঙে গেলে সাধারণত প্রথমে তীব্র ব্যথা বোধ হয়, জায়গাটা ফুলে যায় এবং নড়াচড়া কমে বা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও শুধু এ লক্ষণ দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় না। এক্স-রে করলে নিশ্চিত বোঝা যায় ভেঙেছে কি-না। কোথাও ভেঙে গেলে বা আঘাত পেলে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো আঘাতে হাড় ভেঙে গেলে ব্যথায় রোগী স্থির থাকতে চায় না। আশপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরাও অস্থির হয়ে পড়েন। কেউ আবার গিয়েই টানাটানি শুরু করে, হাড় জোড়া বা সোজা করতে চায়। কিন্তু এতে ক্ষতি আরও বেড়ে যেতে পারে। হাড় ভাঙার ক্ষতির চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে এ টানাটানি। কারণ, ভাঙা হাড় নড়াচড়া করলে ভাঙা অংশ আশপাশের মাংসপেশি, রক্তনালি ছিঁড়ে ফেলতে পারে।

অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ব্লান্ট ট্রমা বা শুধু হাড় ভাঙলে প্রাথমিক অবস্থায় যতটা পারা যায়, কম নড়াচড়া করানো উচিত। রোগীকে স্থির রাখতে হবে, আঘাতপ্রাপ্ত অঙ্গ বা হাত পা নাড়ানো যাবে না। কোনো অবস্থায় শক্ত করে বাঁধা যাবে না। ব্যথা ও ফোলা কমাতে বরফ দিয়ে সেঁক দেওয়া যেতে পারে। এক পা ভাঙলে অন্য পায়ের সঙ্গে বেঁধে নড়াচড়া বন্ধ করে নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়া যায়। হাড় জোড়া বিশেষজ্ঞের কাছেও পাঠিয়ে দেওয়া যায়।

অনেক সময় হাড় ভেঙে গেলে তীব্র ব্যথা না–ও হতে পারে। আদতে হাড় ভেঙেছে কি না, রোগীকে দেখে অনুমান করা দুরূহ হয়ে পড়ে। হাড় ভাঙার পরও স্বাভাবিক নড়াচড়া করতে পারছেন বলে অনেকেই অবহেলা করে, তখনই হাসপাতালে যান না কিংবা হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে যান। যার পরিণাম হয় খুব খারাপ। দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা করালে যত তাড়াতাড়ি হাড় জোড়া লাগার সম্ভাবনা থাকে, দেরি করলে সেটি ক্ষীণ হয়ে যায়। এমনকি হাড় ঠিক জায়গায় জোড়া না লেগে বাঁকাভাবে জোড়া লাগতে পারে বা জোড়া না–ও লাগতে পারে। সারা জীবনের জন্য তখন ভোগান্তি সহ্য করতে হবে।

বয়স্ক মানুষের মধ্যে পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙা বা হিপ ফ্র্যাকচার একটি সাধারণ ঘটনা। কীভাবে এটা প্রতিরোধ করা যায়?

বয়স্কদের হাড় ভাঙার একটি বড় কারণ অস্টিওপোরোসিস। অস্টিওপোরোসিসেরও অনেক কারণ আছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের ঘনত্ব কমতে থাকে। সাধারণত ৫০ বা তার বেশি বয়সীরা এ রোগে আক্রান্ত হন। মেয়েদের মেনোপজের পর হঠাৎ শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যায়। এ কারণে হাড় হয়ে যায় পাতলা এবং ভঙ্গুর। এ রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হলো সারা জীবন সক্রিয় থাকা, নিয়মিত শারীরিক ব্যয়াম, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা। যাদের ঝুঁকি আছে, তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অস্টিওপোরোসিসরোধী ওষুধ দেওয়া যায়। ধূমপান এড়িয়ে চলতে হবে।

তরুণ বয়স থেকেই হাড়ের যত্ন নিতে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে
ছবি: প্র স্বাস্থ্য

বয়স্কদের ফিমার হাড়ের নেক মানে কোমরের হাড় বা তার আশপাশ ভেঙে যায়। সুস্থ মানুষ দাঁড়ানো বা হাঁটা অবস্থায় অথবা সামান্য একটু চোট খেয়ে মাটিতে পড়ে কোমর ভেঙে ফেল। ধরা হয় যে আছাড় খেয়ে বা পড়ে ভেঙে গেছে কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাড় ভেঙে তারপর বৃদ্ধরা পড়ে যান। কোনো কোনো সময় অল্প আঘাতেই হাড় ভেঙে যায় বা ফেটে যায়।

কোমর ভাঙার চিকিৎসা কী?

কোমরের হাড় ভাঙার চিকিৎসা একটু জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ। সার্জনের দক্ষতা আর অপারেশন থিয়েটারের সুযোগ-সুবিধার ওপরও নির্ভর করে এ চিকিৎসার ভবিষ্যৎ। এ সমস্যার আধুনিক চিকিৎসা এখন দেশেই হচ্ছে এবং সফলভাবেই হচ্ছে। হিপ বা কোমর প্রতিস্থাপন করে এ চিকিৎসা করা হয়ে থাকে।

বয়স্কদের হাড়ের যত্ন কীভাবে নেওয়া উচিত?

দেশের মানুষের গড় আয়ু যেমন বাড়ছে, তেমনি বয়স্কদের হাড় ভাঙার সংখ্যাও বাড়ছে, যার মধ্যে ফিমারের নেক ফ্রাকচার বা কোমরের হাড় ভাঙা অন্যতম। এ হাড় ভাঙলে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়। আবার জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ অস্ত্রোপচার বিধায় অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন যে অপারেশন করে যদি উপকার না পাওয়া যায়। তবে অপারেশন করলে রোগীরা দ্রুতই হাঁটতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বয়স তেমন কোনো বাধা নয়।

তবে আমাদের বৃদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই হাড়ের যত্ন নেওয়া উচিত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবারই হাড়ের ঘনত্ব ও শক্তি কমতে থাকে। অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ভঙ্গুরতা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা আজকাল বেড়েছে। এ সমস্যায় হাড়ের ঘনত্ব যায় কমে, ফলে সহজেই ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। কৈশোর থেকে নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত। এতে হাড়ের শক্তি বাড়ে। ২০ বছরের কাছাকাছি বয়সেই হাড়ের ঘনত্ব নির্ধারিত হয়ে যায়। তরুণ বয়স থেকেই তাই হাড়ের যত্ন নিতে হবে। যেমন নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া। ছোটবেলা থেকেই পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। গর্ভাবস্থায়, স্তন্যপান করানোর সময় এবং মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নারীদের বেশি মাত্রায় ক্যালসিয়াম খেতে হবে। পাশাপাশি এ সময় প্রয়োজনে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি বড়ি খেতে হবে। ধূমপান বর্জন করতে হবে।

হাঁটু প্রতিস্থাপন বিষয়ে কথা বলছেন অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বৃদ্ধ বয়স, দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ সেবন, ধূমপান, মাদকাসক্তি, ভগ্নস্বাস্থ্য, আগেও অল্প আঘাতে হাড় ভাঙার ইতিহাস ইত্যাদি হলো ঝুঁকি। বর্তমানে কোভিড-১৯ রোগীদের স্টেরয়েড–জাতীয় ওষুধ গ্রহণের ফলেও হাড়ে পরিবর্তন হয়ে ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। কেউ কেউ আবার মোটাতাজা হওয়ার জন্য এসব ওষুধ সেবন করেন, যার কারণে হাড়ের ঘনত্বে পরিবর্তন হয়ে থাকে। তবে সঠিক সময়ে সমস্যা শনাক্ত হলে হাড়ের ঘনত্ব বাড়ানোর চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। তবে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই অধিক কার্যকর।

বর্তমানে দেশেই হাঁটু প্রতিস্থাপনের মতো আধুনিক চিকিৎসা হচ্ছে, কারা এ চিকিৎসা নিতে পারেন?

বয়স বাড়ার সঙ্গে দুই হাঁটুতে যে ব্যথা হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কারণে। এ ব্যথা হাঁটু ভাঁজ বা নড়াচড়া করলে বাড়ে, কখনো কট কট শব্দ হতে পারে। জীবনাচরণ পরিবর্তন, গরম বা ঠান্ডা সেঁক, ব্যথানাশক ওষুধ, হাঁটুতে ইনজেকশন বা ফিজিওথেরাপি ইত্যাদি দেওয়ার পরও যখন সমস্যার সমাধান হয় না, বরং বিশ্রামে থাকলেও তীব্র ব্যথা হয়, হাঁটু ফুলে যায়, তখন হাঁটু প্রতিস্থাপন হতে পারে ভালো সমাধান। দীর্ঘদিন ব্যথার ওষুধ খেয়ে অনেকে কিডনি নষ্ট করার ঝুঁকিতে পড়েন। সে ক্ষেত্রেও হাঁটু প্রতিস্থাপন নিরাপদ চিকিৎসা।

হাঁটু প্রতিস্থাপনের সফলতার হার ৯৭-৯৮ শতাংশ। সফল হাঁটু প্রতিস্থাপনের পর স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করা যায়। কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে প্রতিস্থাপিত হাঁটু দীর্ঘদিন ভালো থাকে। এ প্রতিস্থাপনের খরচও কোমর প্রতিস্থাপনের মতোই। একটু বেশি হলেও বহির্বিশ্বের তুলনায় কম। তবে সরকার ও সমাজের বিত্তবান মানুষ এগিয়ে এলে সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য করা সম্ভব।

হাঁটু প্রতিস্থাপনের পর রোগীর জীবনযাপন কেমন হয়?

অস্ত্রোপচারের পর এক বা দুদিন পরই উঠে বসা, হাঁটাচলা, ব্যায়াম, সিঁড়ি ভাঙাসহ সব ধরনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারেন রোগী। এতে কোনো ক্ষতি হয় না। চিকিৎসার পর রোগী ২০ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন তেমন কোনো সমস্যা ছাড়াই। কৃত্রিম জয়েন্ট প্রতিস্থাপনের পর খেলোয়াড়েরাও তাদের খেলাধুলা চালিয়ে যেতে পারে।

হাঁটু প্রতিস্থাপনের পর হাঁটু ভাঁজ করে কাজ করতে নিষেধ করা হয়, যাতে প্রতিস্থাপিত হাঁটু দীর্ঘদিন ভালো থাকে। ওজন স্বাভাবিক রাখতে হবে।