ভ্যাক্সিন নিয়ে ভুল ধারণা ভাঙতে হবে

করোনা পরিস্থিতি এখনো অনিয়ন্ত্রিত। অল্প সময়ের মধ্যেই ভ্যাকসিন হয়তো হাতের নাগালে চলে আসবে। কিন্তু এরপরও থাকতে হবে সতর্ক। মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে রয়েছে উদাসীনতা। এতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

ডা. নাদিয়া নিতুলের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন অধ্যাপক ডা. মো. রুল গনি

করোনায় রোগীদের নানা ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা ও এর প্রতিকার নিয়ে প্রথম আলো আয়োজন করে এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ের সুরক্ষা’। অনুষ্ঠানটির নবম পর্বে ডা. নাদিয়া নিতুলের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন অধ্যাপক ডা. মো. রুল গনি, মেডিসিন, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।

অনুষ্ঠানটি ১৭ জানুয়ারি প্রথম আলো ও এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

অনুষ্ঠানের শুরুতে অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল গনি আলোচনা করেন রক্ত জমাট বাঁধা কী এবং এর প্রতিকার নিয়ে। তিনি বলেন, আমরা জানি, করোনার এই সময়ে রক্ত জমাট বাঁধা অত্যন্ত মারাত্মক একটি সমস্যা। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ এই রক্ত জমাট বাঁধা। প্রথমেই আমাদের জানতে হবে রক্ত জমাট বাঁধে কেন এবং কীভাবে বোঝা যাবে রোগীর শরীরে রক্ত জমাট বাঁধছে। যদি দেখা যায় কোনো রোগী কোনো রকম পরিশ্রম ছাড়া বসে বসেই শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, তাহলে বুঝতে হবে তাঁর শরীরে রক্ত জমাট বাঁধছে। যদি তা ফুসফুসে হয়, তবে তাকে বলব পালমোনারি থ্রম্বাস। আবার যদি মস্তিষ্কে হয়, তবে তাকে বলব স্ট্রোক।

সাধারণভাবে জমাট বাঁধা রোগ হাইপারকোয়াগুলেবল অবস্থা হিসেবেও পরিচিত। এই অবস্থায় ধমনির মধ্যে রক্তের ডেলা গঠিত হয়, সেই ডেলা চাপের কারণে বাহিত হয়ে সংবহনের মধ্যে চলে আসে। একবার জমাট বাঁধা রক্ত সংবহনে চলে গেলে সরু রক্তবাহিকা অথবা রক্তজালিকার মধ্যে আটকে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। করোনা রোগী যাঁদের রক্ত জমাট বাঁধার লক্ষণ রয়েছে, তাঁদের জন্যে রিভারক্স একটি ভালো ওষুধ। এই করোনা মহামারিতে আমি বেশ কিছু রোগীর ওপর ওষুধটি প্রয়োগ করে ভালো ফল পেয়েছি। তবে মনে রাখতে হবে, ওষুধ সেবন করতে হবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে।

যাঁদের দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ রয়েছে, তাঁরা এই করোনায় কীভাবে ভালো থাকবেন এবং ভ্যক্সিন কতটা কার্যকর, তা নিয়ে আলোচনা করেন অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল গনি। তিনি বলেন, একটি কথা চিকিৎসকেরা করোনার শুরু থেকেই বলে আসছেন, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্ত চাপ, হৃদ্‌রোগ, অ্যাজমার মতো দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ যাঁদের রয়েছে, তাঁদের খুবই সাবধানে থাকতে হবে। এই রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যাঁরাই এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখছেন না, তাঁদের ইউমিনিটি কমে যাচ্ছে। আর ইউমিনিটি কমে যাওয়া মানেই কো-মরবিলিটি অবস্থা তৈরি হওয়া। সুতরাং, তাঁদের খুবই সাবধানে থাকতে হবে।

বর্তমানে আমাদের দেশে অনেককেই ভ্যাক্সিন নিয়ে নানা ধরনের সংশয় প্রকাশ করতে দেখা যায়। এ জন্য আমাদের আগে জানতে হবে ভ্যক্সিন কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে। ভ্যাক্সিন মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে; যা পরবর্তী সময়ে প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। ভ্যাক্সিনের ওপর বিশ্বাস না রাখার কোনো কারণ নেই। কারণ, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই ভ্যাক্সিন বাজারে ছাড়া হয়। এর অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। ট্রায়ালের মাধ্যমেই এর নিরাপত্তা যাচাই করা হয়। সুতরাং, এ বিষয়ে সন্দেহের তেমন কোনো অবকাশ রয়েছে বলে আমি মনে করি না। আর ভ্যাক্সিনের ব্যবহার বেশ পুরোনো; আমরা পোলিও, হাম, বসন্তের ভ্যাক্সিন গ্রহণ করেছি। করোনার ভ্যাক্সিনও আমাদের গ্রহণ করা উচিত। অনেক ভ্যাক্সিনেরই ছোট ছোট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এটাই স্বাভাবিক।

অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল গনি আলোচনা করেন করোনাকালে সুষম খাবারের ভূমিকা নিয়ে। তিনি বলেন, মহামারির এই সময়ে ব্যালান্সড ডায়েট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দেশে বর্তমানে অনেক ভালো ভালো ডায়েটেশিয়ান রয়েছেন। আমাদের উচিত তাঁদের দিয়ে নিজের জন্য উপকারী ডায়েট চার্ট তৈরি করে নেওয়া। কারণ, আমাদের খাবারে কার্বহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি; যা নানা ধরনের রোগকে বাড়িয়ে তোলে। তাই আমাদের ব্যালান্সড ডায়েটের প্রয়োজন হয়। আমরা জানি না আমাদের দিনে কতটুকু ক্যালোরি প্রয়োজন বা প্রোটিন প্রয়োজন। আবার দিনে কীভাবে কতটুকু ক্যালরি বার্ন করা যাবে, সে বিষয়টিও জানতে হবে। তবেই না আমরা সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারব।

আর করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে একটি বিষয় সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় হচ্ছে, যাঁরা একবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সচেতনতা কম। তাঁরা ভাবছেন, একবার হয়ে গেছে আর হবে না। এটি ভুল ধারণা। করোনা বারবার হতে পারে। আবার না–ও হতে পারে। এ জন্য ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে হবে, অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে, অসুস্থ পশু–পাখির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে, মাছ-মাংস ভালোভাবে রান্না করে খেতে হবে। এ ছাড়া যতটা সম্ভব ঘরে থাকতে হবে, প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যাওয়া ও জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ সব সময়ই উত্তম।