মন ও মানসিক চাপ

ডা. তানিয়া আলমের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন ডা. মোহিত কামাল

মানসিক চাপকে অনেকেই হালকাভাবে দেখে থাকে। অথচ এটি ভীষণই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। মানসিক চাপ থেকেই পরবর্তী সময়ে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ নিয়ে এসকেএফ নিবেদিত তিন পর্বের ‘যত্নে রাখি মনচিঠি’ অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডা. তানিয়া আলমের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট মনোশিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ঢাকার সাবেক পরিচালক ডা. মোহিত কামাল। এ পর্বের আলোচ্য বিষয় ছিল: মন ও মানসিক চাপ।

অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজে সম্প্রচারিত হয়।

ডা. মোহিত কামাল জানান, বর্তমানে মানসিক চাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনার বিষয়। অনেকেই মানসিক সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে চান না। কিন্তু আসলে সময় থাকতেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। তিনি বলেন, বুঝতে হবে যে আমি যা করছি, সেটা আমার মন আমাকে দিয়ে করাচ্ছে। যেমন আমি যে কথা বলার সময় হাত নাড়ছি, মুখ নাড়ছি, চোখ দিয়ে দেখছি, কপালে ভাঁজ হচ্ছে—এসবই হচ্ছে মনের কারণে। মনের চিন্তা, আবেগ, প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা, বুদ্ধি, স্মৃতি—এসবই আমাদের মনের অঙ্ক। যেমন যখন চাপে পড়ব, তখন আমার আবেগের ডিসরাপশন হবে, আমার কগনিটিভ থিঙ্কিংয়ের ডিসরাপশন হবে। তখন আমার আচরণে পরিবর্তন আসবে। সুতরাং, যখন আমার কষ্ট হবে, আমি হু হু করে কাঁদব। আবার যখন খুব রাগ হবে, তখন আমি হয়তো রেগে যাব, আমার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হবে, হয়তো আমার সামনে যে আছে তাকে ঘুষি মেরে বসতে পারি। আমাদের আবেগটা স্বাভাবিক, যখন ঘুষি মেরে বসি, তখন সেটা হয় অ্যাগ্রেশন বা সহিংসতা।

তাহলে মনের অঙ্গগুলোকে আগে আমরা চিনে নিই। একটি আবেগ, একটি প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা, একটি মোটিভেশন (আমার উৎসাহ, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা), যা আমাকে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই গুরুত্বপূর্ণ অনুষদ আমার ইনার ফোর্স, ইনার এনার্জিই হলো মনের অঙ্গ।

আমাদের অনেক সময় এমনও হতে পারে যে কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি কিংবা উৎসাহ পাচ্ছি না; তখন বুঝতে হবে আমার ভেতরের মোটিভেশন অনুপস্থিত রয়েছে কিংবা কাজ করছে না। কোনো বিশেষ কারণ বা সংকটের ফলে এমনটি হতে পারে। যেমন পরীক্ষায় আশানুরূপ ভালো ফল না পাওয়া। সেটাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কৌশলী না হলে হেরে যেতে হয়।

আমরা যারা জাতীয় পরামর্শ কমিটিতে আছি, তাদের একটা স্টাডি বলছে যে ৮৬ শতাংশ শিশু উপসর্গবিহীনভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। আমাদের দেশে যে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে, এর প্রধান কারণ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা। এ পরিস্থিতিকে আমরা মানতে পারছি না কিংবা শিশুরা বন্দী থেকে হাঁপিয়ে উঠছে ঠিকই। কিন্তু আমরা জানি যে কোভিডের ফলে শিশুদের মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটারি ডিজিজ হয়। এই যে ভেতরে–ভেতরে এত শিশু মারা যাচ্ছে, তা যেসব বিশেষজ্ঞরা দেখছেন কিংবা সরকারিভাবে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করছেন এবং যাঁরা টেকনিক্যাল কমিটিতে আছেন, তাঁরা এ অবস্থা দেখে বলছেন যে তাঁরা মৃত্যু চান না, একটি শিশুরও যেন মৃত্যু না হয়। ফলে আমরা একটা আপসের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে এসেছি যে ‘ভাবিয়া করিও কাজ’।

বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে, তারা যদি এভাবে চিন্তা করে যে হুট করে কিছু বিবেচনা ছাড়া নয়, বরং জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফল বিবেচনায় ধারাবাহিকতার মাধ্যমে তাদের মেধা যাচাই করা হচ্ছে। এমন ভাবনা তাদের মানসিক চাপ কমতে পারে। তাদের উদ্দেশে আমি বলব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তোমাদের মেধার প্রমাণ দেওয়ার সুযোগ আছে। কাজেই সময়কে যতটা সম্ভব কাজে লাগাতে হবে। এ যুদ্ধের ময়দানে সরকারের সিদ্ধান্তের নেতিবাবচক প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বরং ইতিবাচকভাবে নিতে হবে। সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে হবে। ভর্তি পরীক্ষার জন্য সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে চেষ্টা করতে হবে এবং ফলাফল যা-ই আসুক, তাকে বরণ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। এতে তাদের মানসিক চাপও কমে যাবে।

মানসিক স্বাস্থ্যের বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানসিক সুস্বাস্থ্য সেই অবস্থাকে বলা হবে, যখন কোনো ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে শনাক্ত করবে, দৈনন্দিন জীবনের চাপগুলোকে মোকাবিলা করবে, নিজের কাজকে যোগ্যতার সঙ্গে করবে এবং সমাজকে কিছু দেবে। আর এর ব্যতিক্রম হলেই সে মানসিক চাপের সম্মুখীন হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরিবারের সহযোগিতা খুবই জরুরি। যেমন বর্তমানে ধর্ষণের প্রকোপ খুব বেড়েছে। এ সময় ভিকটিমের পরিবারকে বুঝতে হবে যে এখানে ভিকটিমের দোষ নেই। তাই তাদের উচিত এসব অন্যায় আচরণ ধামাচাপা না দিয়ে বরং ভিকটিমের পাশে এসে দাঁড়ানো এবং প্রতিবাদের মাধ্যমে তার মানসিক শক্তি ফিরিয়ে আনা। এতে তার মানসিক চাপ কমে যাবে এবং সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে সক্ষম হবে।