মাটি থেকে এক ফুট ওপরে হাঁটা

পেশায় সহকারী অধ্যাপক, প্যাশনে দৌড়বিদ। স্কুলের দুরন্ত সময়ে দৌড়ে পিছিয়ে থাকা সেঁউতি সবুর নিজের অধ্যবসায়, চেষ্টা আর ভালো লাগার সমন্বয়ে হয়ে উঠেছেন এই সময়ের অন্যতম আলোচিত ম্যারাথন তারকা।

উইমেন হরলিকস নিবেদিত প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজন ‘ম্যারাথন আলাপন’ অনুষ্ঠানে তুলে সেঁউতি সবুর ধরলেন নিজের অভিজ্ঞতা, বিডি রানার্স পরিবার ও দৌড়কে ঘিরে থাকা অনেক গল্প। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রচারিত অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন ডা. শ্রাবণ্য তৌহিদা।

ডা. শ্রাবণ্য তৌহিদা সঞ্চালনায়সেঁউতি সবুর ধরলেন নিজের জীবনের গল্প

শুরু

দৌড় শুরু করতে বেশ দেরিই হয়েছে সেঁউতির। স্কুলে যে খুব ভালো দৌড়েছেন, তা মোটেও নয়। সব সময় মজা করে বলেছেন, স্কুলে আমি উল্টো দিক থেকে প্রথম হতাম! তারপরও জীবনে একটা লক্ষ্য ছিল, যে কাজগুলো কখনোই পারেন না, সেগুলো করার চেষ্টা করা। তাই ৪০তম জন্মদিনের আগে মনে হলো এবার একটু দৌড়ে দেখি! ২০১৬ সালের মাঝামাঝি হাঁটার পাশাপাশি নিজের মতো জিমে গিয়ে দৌড় অনুশীলন শুরু করেন তিনি। ২০১৭ সালে শুরুতে প্রথম উইমেন্স মিনিম্যারাথনে অংশগ্রহণ করা, শেষ দিকে বিডি রানার্সের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এরপর থেকে দৌড় চলছেই।

পাশে ছিলেন যাঁরা

পেয়েছেন স্বামীর অনুপ্রেরণা

সেঁউতির স্বামী ইমতিয়াজ এলাহী একজন ট্রাই-অ্যাথলেট। তাঁর অণুপ্রেরণা তো ছিলই, কিন্তু বিডি রানার্স পরিবারের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞতা সেঁউতির। প্রথম উইমেন্স ম্যারাথনে প্রথম হওয়ার অর্জনের পেছনে বিডি রানার্সের পরমা, হাসিব, সজীব, হক মঞ্জুরসহ প্রত্যেক সদস্য যেভাবে তাঁকে উৎসাহ জুগিয়েছেন, তা ভোলার নয়। কারণ, যতই চেষ্টা করুন, একা দৌড়ানো একটু মুশকিলই বটে। সেঁউতির মতে, অনেকেই পারিবারিক সমর্থনের অভাবের কথা বলেন, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে পরিবার মানুষের নিজস্ব ইকো সিস্টেমেরই অংশ। বুঝিয়ে বলতে পারলে যেকোনো কাজ পরিবারের সমর্থন নিয়েই করা সম্ভব।

উল্লেখযোগ্য অর্জন

বিডি রানার্সের একজন অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে সেঁউতি মনে করেন, বাংলাদেশে দৌড়ের প্রেক্ষাপটে নারীদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব তাঁর দেখা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন। যেকোনো ম্যারাথন ও দৌড়ে এখন নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কোচ, পেসার ও ট্রেইনার হিসেবে ১০ জনের মধ্যে অন্তত ৪ জনই নারী। শীত এলেই আজকাল দেশের আনাচকানাচে দৌড়ের ইভেন্ট তৈরি হচ্ছে, এই উদ্যমটা তাঁরা ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। অনলাইনে এবং অফলাইনে নারীদের হ্যারাসমেন্ট আরও ভালোভাবে ঠেকিয়ে দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে, এটাও কম অর্জন নয় বলে তিনি মনে করেন।

ভালো লাগা স্মৃতি

বিডি রানার্স পরিবারের সঙ্গে অসংখ্য ভালো লাগার মুহূর্ত আছে সেঁউতির

বিডি রানার্স পরিবারের সঙ্গে অসংখ্য ভালো লাগার মুহূর্ত আছে সেঁউতির, যেগুলো অনেক কিছু শিখিয়েছেও। গত বছর সিঙ্গাপুর ম্যারাথনে দৌড়াতে গিয়ে দেখলেন আবহাওয়া অসম্ভব আর্দ্র। দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে। প্রায় দেড় ডজন বাংলাদেশি অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৪ জন একতালে দৌড়াচ্ছেন, এঁদেরই একজন সামনে এগিয়ে গেলেন। বাকি তিনজন ফিনিশ লাইনের কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি এখনো দাগ পেরোননি। এপারেই বসে আছেন, সবার সঙ্গে একবারে শেষ করবেন! দৌড়ের রাস্তায় এই টানটুকু শুধু সেঁউতির জন্য নয়, সবার জন্যই। যেমন কোনো ইনজুরি হলে ছেলেমেয়ে বিষয় নয়, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেডিকেল সাপোর্ট দেওয়াটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। সেঁউতি মনে করেন, এই ছোট ছোট বিষয়ই মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। লিঙ্গের ঊর্ধ্বে গিয়ে সহমর্মিতা দেখানো শেখায়। আর দিন শেষে স্ট্রেস রিলিভ করার জন্য এমন পারিবারিক পরিবেশের বিকল্প হওয়া সম্ভবই না! তবে হাসাহাসিটা হয় নিজের ঘরে। মেজ বোন স্প্রিন্টার ছিলেন, ছেড়ে দিয়েছেন। আর সেঁউতি ছাড়ার সময়ে শুরু করেছেন। কিন্তু অধ্যাপক হওয়ার জন্য অনেক ছাত্র, সহকর্মী ও বন্ধু তাঁকে দেখে আবার দৌড় শুরু করেছে। সকালে দৌড়াতে বের হলে ডিওএইচএস থেকে হাতিরঝিলে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি দারোয়ান, পাহারাদার এখন সালাম দেয়, কুশল জিজ্ঞেস করে। এই যে সম্মানটার কারণে সেঁউতির মনে হয়, মাটি থেকে এক ফুট ওপরে হাঁটছেন।

স্ট্রেংথের উৎস

সেঁউতি মনে করেন, প্রতিটি মানুষ অপার সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা আমাদের শিকলে আটকে রাখে। একবার উঠে দাঁড়ালেই দেখবেন শিকলগুলো নিজ থেকে খুলে পড়ে যাচ্ছে। দৌড়াতে গেলে ফ্যাটিগ হবে, ইনজুরি হবে, দুটি কটু কথা শোনা লাগবে। এসবের মধ্যেই মনে করতে হবে, আপনি একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মানসিক প্রস্তুতি নিলেই আর শরীরে গায়ে লাগে না। নিজের বিশ্বাসের ওপরে অটুট থাকা জরুরি। তবে নিয়মানুবর্তী জীবনযাপনটাও মুখ্য। কী পরিমাণ খাবার ও পানি খাচ্ছেন, কী পরিমাণ ঘুমাচ্ছেন, পারিবারিক ও প্রফেশনাল কাজ, সবকিছুর ব্যালেন্স করতে পারলে স্ট্রেংথটা বেড়ে যায়। সবকিছু সামলে নিজেকে শক্ত রাখার সূত্র একটাই, শারীরিক ও মানসিকভাবে আহত না হওয়া। সব সময় নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত রাখা।

নারীদের জন্য

তিরিশের পরে যেসব নারী দৌড়াবেন, তাঁদের জন্য ক্যালসিয়াম খুব জরুরি।

সামনেই আসছে ঢাকা হাফ ম্যারাথন। প্রস্তুতির জন্য সেঁউতির পরামর্শ প্র্যাকটিস চালিয়ে যাওয়ার। ছুটির দিনগুলোয় লম্বা দৌড় চলতে পারে। কিন্তু অন্য দিনগুলোয় ৫ কিলোমিটার, ১০ কিলোমিটার, এমন ছোট ছোট দৌড় চালিয়ে যেতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, যেন ইনজুরি না হয়। তিরিশের পরে যেসব নারী দৌড়াবেন, তাঁদের জন্য ক্যালসিয়াম খুব জরুরি। অনুশীলনের সময় সেঁউতি দিনে ২ গ্লাস দুধ, এক কাপ দই খান এবং প্রয়োজনে প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট নেন। এসবের পাশাপাশি ভিটামিন ডির জন্য রোদে বের হওয়ার প্রতিও তিনি গুরুত্ব দেন।