মানসিক রোগ অন্যান্য রোগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ

আজ ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সাধারণভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বলতে আমরা বুঝি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য তা মেনে চলা। মানসিক রোগের লক্ষণ জানা, চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া ও প্রয়োজনে সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করাও মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা। সঠিকভাবে চিন্তা ও অনুভব করা, সঠিক আচরণ করতে পারাকে মানসিক স্বাস্থ্য বোঝায়, যা ব্যক্তির ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

রোগীর তুলনায় চিকিৎসক কম

সারা বিশ্বে মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। মহামারিকালের বিধিনিষেধে মানসিক স্বাস্থ্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসাপদ্ধতিও উল্লেখ করার মতো উন্নত হয়েছে। তবে সচেতনতার অভাবে মানসিক রোগ ও রোগীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এখনো জোরালোভাবে বিদ্যমান। এ জন্য অনেক সময় রোগী অবহেলার শিকার হয়। সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়।

প্রতীকী ছবি
ছবি: প্রথম আলো

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব ১৭ শতাংশ, যার তুলনায় যোগ্যতাসম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে কম। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের মধ্যে আছেন সাইকিয়াট্রিস্ট (মানসিক বা মনোরোগ চিকিৎসক), ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মী আছেন। তুলনামূলকভাবে অনেক কম ও শহরকেন্দ্রিক চিকিৎসাব্যবস্থা হওয়াতে মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিতে পারে না।

মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা কেন জরুরি?

সারা বিশ্বে বিশাল জনগোষ্ঠী মানসিক রোগে ভুগছে। নানা কুসংস্কার আর অসচেতনতার কারণে তা গোপন করা হয়। ফলে এই রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নীরবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। মানসিক রোগ মোকাবিলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সচেতনতা, যা প্রতিরোধ ও প্রতিকার উভয় ক্ষেত্রেই অত্যন্ত জরুরি। বিষণ্নতা, অ্যাংজাইটি, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, সাইকোসিস ডিজঅর্ডার, সাবস্টেন্স অ্যাবিউজ, ওসিডি, হেলথ অ্যাংজাইটি, পোস্ট ট্রমাটিক ট্রেস ডিজঅর্ডার, প্যানিক অ্যাটাক, ফোবিয়া, কনভারশন ডিজঅর্ডার, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার—মানুষ প্রতিনিয়ত এগুলোতে ভুগছে। এ ছাড়া আরও নানা রকমের মানসিক রোগের অস্তিত্ব আছে। শিশু, বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ যেকোনো বয়সের মানুষই মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। একেকটা মানসিক রোগের ধরন ও লক্ষণ একেক রকম। তবে এগুলোর সবই ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

যে ভুল করবেন না

মানসিক রোগীদের বিশাল একটা অংশ সুস্থ হওয়ার আশায় (মেডিকেল চিকিৎসার বাইরে) নানা রকম অপচিকিৎসার আশ্রয় নেয়। এতে রোগী দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে থাকে। নানা জায়গায় প্রচুর টাকাপয়সা অপচয় করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে একটা সময় তারা হতাশ হয়ে যায়, হাল ছেড়ে দেয়, আবার কেউ কেউ শেষ চেষ্টা হিসেবে চিকিৎসা নেওয়া শুরু করে। তত দিনে রোগের জটিলতা বহুগুণে বেড়ে যায়। আর আর্থিক সংগতিও থাকে না। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও কমে আসে। সময়মতো রোগের লক্ষণ নির্ণয় করে তার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি। যেন আক্রান্ত ব্যক্তি মানসিক রোগের কষ্ট ও ভয়াবহতা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। মানসিক রোগ শারীরিক রোগের মতোই একধরনের রোগ। শারীরিক রোগের মতোই গুরুত্ব দিয়ে এর চিকিৎসা হওয়া জরুরি।

মানসিকভাবে সুস্থ্য থাকা খুবই জরুরি
ছবি: প্রথম আলো

যেসব কারণে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা জরুরি

মানসিক রোগ ও তার লক্ষণ সম্পর্কে জানা চিকিৎসাসংক্রান্ত সঠিক তথ্য জানা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা

মানসিক রোগের কারণ ও চিকিৎসাবিষয়ক কুসংস্কার দূর করা মানসিক রোগ নিয়ে সমষ্টিগত নীরবতার চক্র ভাঙা

মানসিক রোগকে রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ও গুরুত্বসহকারে রোগীর চিকিৎসা করা মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে মানসিক রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা

সচেতনতা বাড়ানোর উপায়

প্রত্যেক মানুষের সামান্য সচেতনতা ও সহযোগিতা মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখতে পারে।

  • মানসিক রোগ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ও কুসংস্কার দূর করার জন্য এ বিষয়ে সব জায়গায় সহজ ও স্বাভাবিকভাবে আলোচনা করা, এই বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও অন্যের অভিজ্ঞতা (অনুমতি সাপেক্ষে) ভাগাভাগি করা

  • মানসিক রোগীর পরিবর্তে রোগের বিষয় নিয়ে (অর্থাৎ রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে) আলোচনা করা

  • মানসিক রোগকে রোগ হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া ও অন্যান্য শারীরিক রোগের মতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা

  • নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়া ও অন্যকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করা

  • মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য জানা ও অন্যদের জানানো

  • স্বাভাবিক জীবনযাত্রার বাইরে অস্বাভাবিক যেকোনো লক্ষণ বা আচরণ দেখা দিলে নির্ভরযোগ্য কারও পরামর্শ নেওয়া, পেশাজীবীদের শরণাপন্ন হওয়া

মানসিক রোগ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ও কুসংস্কার দূর করতে হবে
প্রতীকী ছবি, পেকজেলসডটকম
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে লেখালেখি করা

  • টেলিভিশনে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও আলোচনা করা

  • নাটক–সিনেমার মাধ্যমে মানসিক রোগ ও তার চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য প্রচার কর

  • মানসিক রোগকে গালি হিসেবে ব্যবহার না করার জন্য সবাইকে পরামর্শ দেওয়া

  • রোগীকে তার রোগের নাম দিয়ে ‘লেবেলিং’ না করা, অর্থাৎ রোগীকে রোগের নাম ধরে না ডাকা

  • মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষা–নিরীক্ষার সুযোগ বাড়ানো

  • কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ দেওয়া

  • স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা, অন্ততপক্ষে চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া

  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়), অফিস বা কর্মস্থলগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা ও মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী নিয়োগ করা।

কোথায় পাব সেবা

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগেও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে। আর মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক রোগ বিভাগের মতো বিশেষ ব্যবস্থা তো আছেই। লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।