১৮ অক্টোবর বিশ্ব মেনোপজ দিবস
মেনোপজের পরও থাকুন সুস্থ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং আন্তর্জাতিক মেনোপজ সোসাইটির উদ্যোগে প্রতিবছর ১৮ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী মেনোপজ দিবস পালিত হয়। মেনোপজ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে দিবসটির যাত্রা ১৯৮৪ সালে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য—বোন হেলথ বা হাড়ের স্বাস্থ্য
একজন নারী তাঁর জীবনচক্রের শৈশব, কৈশোর এবং পূর্ণ বিকশিত প্রজননক্ষম সময় পেরিয়ে একসময় মধ্য বয়সে উপনীত হন। প্রতিটি পর্যায়েই নারীর জীবনে হরমোনজনিত নানা রকম পরিবর্তন ঘটে। এ বয়সও ব্যতিক্রম নয়। একটা বয়সের পর নারী হরমোনগুলো নিম্নমুখী হতে থাকে, ডিম্বাণুর পরিস্ফুটন বন্ধ হয়ে যায় বলে আর মাসিক হয় না এবং সন্তানধারণের সক্ষমতা থাকে না—এ পরিবর্তনকালকেই বলা হয় ‘মেনোপজ’।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘মেনোপজ’ বলতে বোঝায় নারীর মাসিক ঋতুচক্র চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া। মাসিক যদি একাধারে ১২ মাস বন্ধ থাকে, তখন সেই নারী মেনোপজে পৌঁছেছেন বলে ধরা হয়। এটি হয় যখন ডিম্বাশয় সম্পূর্ণরূপে ডিম্বাণু পরিস্ফুটন বন্ধ করে দেয়। ফল হিসেবে শরীরে নারী হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন কমতে থাকে। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যেই নারীদের মেনোপজ হয়ে থাকে। মেনোপজের গড় বয়স ৫০ বছর। ৪০ বছরের আগেও এ ঘটনা ঘটতে পারে, ৪০–এর আগে কারও মেনোপজ হলে তাকে বলা হয় ‘প্রিম্যাচিউরড মেনোপজ’। আবার ৫৫ বছরের পরে প্রতি মাসে মাসিক হওয়াটাও স্বাভাবিক নয়।
কীভাবে বুঝবেন মেনোপজ হয়েছে?
যখন একজন নারীর কোনো অসুস্থতা অথবা ওষুধ ছাড়া একনাগাড়ে ১২ মাস মাসিক বন্ধ থাকে, তখন তিনি মেনোপজে পৌঁছেছেন বলে ধরা হয়। মেনোপজের আগে অনেক নারীর নানা কারণে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে, কিছুদিন বন্ধ থাকা, দেরি করে হওয়া, অথবা ঘন ঘন মাসিক হওয়া, পরিমাণে বেশি বা কম হওয়া ইত্যাদি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অন্য কোনো বিশেষ কারণ আছে কি না খতিয়ে দেখতে হয়।
ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত নারী হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন নারী দেহের সৌন্দর্য, নিয়মিত মাসিক ও সন্তান ধারণ, ত্বকের লাবণ্য ও কমনীয়তা, স্বাভাবিক যৌনজীবন ও যৌনচাহিদা, চুলের ঘনত্ব, হাড়ের ক্ষয়রোধ, হৃদ্যন্ত্রের সচলতা ও মনোদৈহিক কর্মক্ষমতা ধরে রাখে। মেনোপজের পর এ হরমোন কমে যাওয়ার কারণে শরীর ও মনে তার কিছু প্রভাব পড়তে থাকে।
এ কারণে মাসিক একাধারে এক বছর বন্ধ থাকার পাশাপাশি আরও কিছু উপসর্গ দেখা যায়—
হট ফ্লাশ: হঠাৎ হঠাৎ শরীরে অনেক গরম লাগা, ঘাম হওয়া, অস্থিরতা বোধ হতে পারে। এটা দিনে অনেকবার হতে পারে এবং কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
নাইট সোয়েট: রাতে অতিরিক্ত ঘাম এমনকি এসির মধ্যেও ঘামতে থাকা।
অনিয়মিত ঘুম: ঘুম ভেঙে যাওয়া বা ঠিকমতো না হওয়া।
আবেগীয় পরিবর্তন: আবেগপ্রবণতা, ভুলে যাওয়া, অস্থিরতা, মন–মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মাথাব্যথা, কোনো কিছুতে মন স্থির করতে না পারা, অবসাদগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে।
ত্বকের পরিবর্তন: চুল পড়ে যাওয়া, ত্বক পাতলা হওয়া ও সজীব ভাব নষ্ট হওয়া, ত্বকের শুষ্কতা, মেছতা বা মেলাসমা–জাতীয় সমস্যা হতে পারে।
প্রজননতন্ত্রের সমস্যা: মূত্রথলির পেশির টান কমে যাওয়ার কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব ও প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারার সমস্যা ভোগাতে পারে। এ ছাড়া যোনির শুষ্কতা, যৌনচাহিদা কমে যাওয়া, যৌনমিলনে অস্বস্তি বা ব্যথা পাওয়া ইত্যাদি হতে পারে।
অন্যান্য: মেনোপজের পর হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে। রক্তচাপ বা রক্তের চর্বি বাড়া, হৃদ্রোগ ধরা পড়ার মতো ঘটনা ঘটে।
মেনোপজের পর জীবনাচরণ
ওজন নিয়ন্ত্রণ: এ বয়সে অনেকেরই ওজন বেড়ে যায়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্যালরি মেপে সুষম স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণ মেনোপজের উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে। অতিরিক্ত তেল, চর্বি, কোমল পানীয়, জাংক ফুড, লাল মাংস, মিষ্টিজাতীয় খাদ্য পরিহার করতে হবে।
বাড়তি লবণ খাওয়া যাবে না। দুধ, টক দই, সবুজ সবজি ও ফল, ছোট মাছ খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি–সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। কারণ, মেনোপজের পর হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ে। ধূমপান, মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
ফিটনেস: ফিটনেস বাড়াতে প্রতিদিন ৩০-৪০ মিনিট হাঁটা, যোগব্যায়াম বা নিয়মিত শরীরচর্চা করা উচিত এ সময়। হাড়ক্ষয় ও হাড় ভাঙার ঝুঁকি কমাতে ভারসাম্য রক্ষার ব্যায়াম (ব্যালান্সিং এক্সারসাইজ) করবেন। প্রতিদিন কিছু সময় রোদে কাটাবেন।
প্রফুল্ল থাকুন: আবেগীয় সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সব সময় প্রফুল্ল থাকুন। মানসিক চাপ কমান। নিজেকে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিযুক্ত রাখা ভালো। নিজেকে সময় দিন। সমাজসেবামূলক কাজ, বাগান করা, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো, বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদি করতে পারেন।
চিকিৎসা: মেনোপজের পর হাড়ক্ষয়ের ঝুঁকি কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে পারেন। এ সময় নিয়মিত রক্তচাপ, রক্তের সুগার ও চর্বি ইত্যাদি পরীক্ষা করুন। কোনো সমস্যা ধরা পড়লে তার চিকিৎসা নিন। যাঁদের ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, ডিসলিপিডেমিয়া আছে, তাঁরা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করুন। হট ফ্লাশের সমস্যা অতিরিক্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এ জন্য চিকিৎসা নিতে পারেন।
মেনোপজ মানে নতুন জীবন
অনেকেই মনে করেন, মেনোপজ মানেই জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া। কিন্তু আসলে তা নয়। মেনোপজের পর জীবনের নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করবেন আপনি। জীবনচক্রের এটি একটি স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বর্তমান যুগে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় পার করতে হয় এ মেনোপজের পরে। পরিণত বয়সে এসে একজন নারী এ সময় সমাজকে আরও অনেক কিছু দিতে পারেন। তাই এটিকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া এবং এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা, জীবনাচরণে পরিবর্তন আনা, প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার ও সেবনের মাধ্যমে জীবনের এ পর্যায়কে পূর্ণভাবে উপভোগ করুন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গাইনিকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগ, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।