রামপালের গ্রামে টেলিমেডিসিন সেবা

  • এই ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রামপালের ঝনঝনিয়াতে বাস্তবায়নাধীন আমাদের গ্রাম ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রের একটি প্রকল্প হিসেবে কাজ করবে।

  • বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আর্থিক সহায়তায় ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।

  • এই কেন্দ্রে বর্তমানে ১১ জন কর্মী রয়েছেন।

রোগী দেখায় স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে ভিডিওতে যুক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকছবি: প্রথম আলো

সাদা দেয়ালের ঘরটির ওপরে লাল টিনের ছাউনি। নতুন ভবন তাই ঝকঝকে–তকতকে। সামনের উঠানে গোলপাতা আর বাঁশের তৈরি গোল ঘর সেখানে। আরেকটি তৈরি হচ্ছে। মূল ভবনে কয়েকটি ঘর। সব ঘরেই কম্পিউটার, ওয়েবক্যাম, ল্যাপটপ, বড় পর্দার মনিটর বা স্মার্টটিভি। বিকেল হতেই একজন-দুজন করে আসতে শুরু করলেন। স্বাস্থ্যকর্মীর সামনে বসে শারীরিক সমস্যার কথা বললেন। চিকিৎসা সহকারীর (মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট) সামনে মনিটর আর ওয়েবক্যাম। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেখানে যুক্ত খুলনার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। রোগীর সঙ্গে তিনিও কথা বললেন। দরকারি পরামর্শ দিলেন।

শ্রীফলতলা গ্রামে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র
ছবি: প্রথম আলো

এ চিত্র বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার শ্রীফলতলা গ্রামের। যে ভবনের কথা বলা হলো, সেটি আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পের ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। আমাদের গ্রাম বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এডুকেশন সোসাইটির (বিএফইএস) একটি প্রকল্প। এই ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে গত ১৭ নভেম্বর থেকে। ১১ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে এর কার্যক্রম।

গত ১৭ নভেম্বর বিকেলে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের হলরুমে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্পের পরিচালক রেজা সেলিম। তিনি বললেন, গ্রামের মানুষের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা পাওয়া সহজ নয়। আর করোনাকালে তা আরও দুরূহ। সাধারণ রোগের চিকিৎসা যাতে সহজে মেলে, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। করোনাকালে টেলিমেডিসিন সেবা আলোচিত ও কার্যকর এক পদ্ধতি। গ্রামে সেটির প্রয়োগ করলে মানুষের কাজে লাগবে।

এ উপস্থাপনার সময় উপস্থিত ছিলেন খুলনা অঞ্চলের ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার দেওয়ান লালন আহমেদ, রামপাল উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুল জলিলসহ আমাদের গ্রামের কর্মীরা। ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের নাক-কান-গলা বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘এই সময়ে চিকিৎসাসেবা দিতে টেলিমেডিসিন আমাদের লাগবে। গ্রামভিত্তিক এই উদ্যোগ একটা উদাহরণ।’ একই দিন সকালে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়েছিলেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব মামুনুর রহমান ও যুগ্ম সচিব এ কে এম সোহেল।

আমাদের গ্রামের ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে তিন স্তরে রোগী দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। মাঠকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগীর তথ্য নিয়ে আসেন। রোগী সরাসরি এই কেন্দ্রে এসে স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। সে সময় খুলনা মহানগরে আমাদের গ্রামের ক্যানসার নিরীক্ষণ ও চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসক ভিডিও কলে যুক্ত থাকেন। প্রয়োজনে ঢাকায় থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও দরকারি পরামর্শ দেন।

রোগীর তথ্য লিখে রাখা হচ্ছে, যা পরে ডেটাবেইসে যুক্ত হবে
ছবি: প্রথম আলো

এই ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রামপালের ঝনঝনিয়াতে বাস্তবায়নাধীন আমাদের গ্রাম ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রের একটি প্রকল্প হিসেবে কাজ করবে। বাংলাদেশ সরকারের সমাজসেবা ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আর্থিক সহায়তায় ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। শ্রীফলতলার ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে সাধারণ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে এক্স-রে, ইসিজিসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থাও রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। এই কেন্দ্রে বর্তমানে ১১ জন কর্মী রয়েছেন। খুলনায় রয়েছে আমাদের গ্রামের স্তন ক্যানসার নির্ণয় ও নিরীক্ষণ কেন্দ্র। সেখানে ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ড (ইএমআর) সফটওয়্যারের মাধ্যমে রোগীর তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। এই সফটওয়্যার গ্রামের এই কেন্দ্রেও ব্যবহার করা হবে। আমাদের গ্রামের উদ্যোগে রামপাল সদর ইউনিয়নের ২৪টি গ্রামের প্রতিটি বাড়ির সব ধরনের তথ্য ডেটাবেইস গড়ে তোলা হয়েছে। এমনকি আসবাবপত্র, বাদ্যযন্ত্র, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশুর তথ্যও আছে। যেগুলো নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে।

মাইক্রোসফটের টিমস হেলথ কেয়ার অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে ভিডিও সভা বা কনফারেন্স করা হচ্ছে এখানে। টেলিমেডিসিন সেবার জন্য মাইক্রোসফটের ডিজিটাল হেলথ সফটওয়্যারও ব্যবহার করা হচ্ছে এই কেন্দ্রে। ডিজিটাল হেলথ সফটওয়্যারের শতাধিক লাইসেন্স অনুদান হিসেবে দিয়েছে মাইক্রোসফট করপোরেশন। আরও দিয়েছে অফিস ৩৬৫ সফটওয়্যারের লাইসেন্স। এই কেন্দ্রে ব্যবহার করা হচ্ছে বিটিসিএলের উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ।

কথা হলো ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের চিকিৎসা সহকারী মৌসুমী তালুকদারের সঙ্গে। তিনি দুই বছর ধরে এই প্রকল্পে কাজ করছেন। বললেন, গ্রামের মানুষ বেশ আগ্রহী ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারে। সহজেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, এটাই বড় ব্যাপার।

রক্তচাপ মাপা হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী প্রযুক্তিরও প্রয়োগ ঘটনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। রেজা সেলিম বললেন, ‘ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রোগীকে যাতে সহজে উপজেলা হাসপাতাল পর্যন্ত আনা যায়। সেই অ্যাম্বুলেন্সে ট্যাবলেট কম্পিউটারসহ স্বাস্থ্যকর্মী থাকবেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই ট্যাবে যুক্ত থাকবেন দূরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। যাতে রোগীকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা যায়।’

প্রযুক্তির নানা রকম ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়াটাই এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য। পরীক্ষামূলক পর্যায়ে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এই কেন্দ্র থেকে। করোনাকালে প্রত্যেক রোগীর শরীরে তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। করোনার অ্যান্টিবডি/অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থাও এখানে থাকবে। এখন রবি থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে।