রুকসানার অক্সিজেন নেমেছিল ২৫ শতাংশে

করোনাকালেই সুখবরটা পেয়েছিলেন রুকসানা হাসান ও রাকিবুল হাসান দম্পতি। তাঁরা মা-বাবা হতে চলেছেন। সময়টা খারাপ, তাই ভীষণ সতর্ক ছিলেন দুজন। রুকসানা গৃহবধূ, বাড়িতেই থাকতেন বেশির ভাগ। রাকিবুল ব্যবসায়ী, ব্যবসার কাজে বাইরে যেতে হলেও খুবই সাবধানে থাকেন। কিন্তু বিধি বাম। ৭ অক্টোবর প্রথম জ্বর অনুভব করলেন রুকসানা। তারপর খেয়াল করলেন তিনি কোনো খাবারেই স্বাদ-গন্ধ পাচ্ছেন না। চিন্তিত হয়ে উঠলেন তাঁরা। লক্ষণগুলো তো কোভিডের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। রুকসানার তখন গর্ভকালের ২৭ সপ্তাহ চলছে। দেরি না করে পরদিনই তাঁরা কোভিড টেস্ট করালেন। সবকিছু ওলটপালট করে দেওয়া বার্তাটি এল ৯ অক্টোবর সকালে।

রুকসানা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের পরামর্শ অনুযায়ী রিপোর্ট নিয়ে তাঁরা সেদিনই দেখা করলেন ঢাকার গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রাশেদুল হাসানের সঙ্গে। সে সময় তাঁর শরীরে অক্সিজেন নিঃসরণের (স্যাচুরেশন) মাত্রা ৯২–৯৩ শতাংশে ওঠানামা করছিল। ডা. রাশেদুল ঝুঁকি না নিয়ে তাঁকে তখনই ভর্তি হতে বললেন হাসপাতালে। ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন। বললেন পরদিন সকালে রাউন্ডে দেখা হবে।

রুকসানা ও রাকিবুল হাসান
সংগৃহীত

কিন্তু পরদিন ভোর থেকেই অস্থিরতা শুরু হলো রুকসানার। দ্রুত কমে যাচ্ছিল অক্সিজেন স্যাচুরেশন। কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাঁকে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা দিয়ে অক্সিজেন দিচ্ছিলেন। কিন্তু একটু পর রাউন্ডে এসে গম্ভীর হয়ে পড়লেন চিকিৎসক। সর্বোচ্চ মাত্রার অক্সিজেন দিয়েও রুকসানার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৫ শতাংশে নেমে যাচ্ছে। তারপর ৭০ শতাংশে। চিকিৎসক বললেন এক্ষুনি তাঁকে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) নেওয়া দরকার। ভাগ্যিস আইসিইউতে আসন ফাঁকা পাওয়া গেল। দ্রুত সেখানে নেওয়া হলো। এর একটু পরই রুকসানার অক্সিজেন আরও নিচে নেমে যেতে থাকল, একেবারে ২৫ শতাংশের কাছাকাছি। বাধ্য হয়ে চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়ার।

পুরো সময়টা জ্ঞান ছিল রুকসানার। শ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হলেও কী ঘটতে চলেছে, সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। শুনতে পাচ্ছিলেন সব কথা, তাঁকে ঘিরে সব আলাপ–আলোচনা। এই ফাঁকে তাঁর স্বামী রাকিবুল হাসানকে ডেকে কাউন্সেলিং করেছেন চিকিৎসকেরা, প্রস্তুত থাকতে বলেছেন যেকোনো অঘটনের জন্য। আর এ–ও বলে নিয়েছেন যে রীতি অনুযায়ী মাকে বাঁচানোর চেষ্টাই হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে, রাকিবও সায় দিয়েছেন তাতে। রুকসানাকে বাঁচানোর জন্য যা যা দরকার সবই যেন করা হয়, অনুরোধ করেছেন তিনি। শুরু হলো করোনার বিপরীতে রুকসানার মরণপণ যুদ্ধ। এ এক অসম যুদ্ধই বলা চলে। একে তো তিনি অন্তঃসত্ত্বা, নাজুক শরীর। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম। তার ওপর আগে থেকেই তাঁর উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েডের সমস্যা, ডায়াবেটিসসহ আরও কিছু জটিলতা ছিল। সব মিলিয়ে খুব আশাপ্রদ ছিল না তাঁর অবস্থা।

বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা বলে যে কোভিড রোগীর লাইফ সাপোর্ট বা ভেন্টিলেশন থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে দিনের পর দিন তাঁকে দেখে মন খারাপ করতেন সবাই। চিকিৎসক, নার্স সবাই ধরে নিয়েছিলেন রুকসানা মনে হয় শেষ পর্যন্ত পারবেন না। হার মানবেন করোনার কাছে। কিন্তু আশ্চর্য যে রুকসানা একবারও ভরসা হারাননি। ভেন্টিলেশনে পুরো ১১ দিন তাঁর জ্ঞান ছিল টনটনে।

রাকিব হাসান বলেন, যখনই দেখতে গেছি কখনো ওকে হাসি মুখ ছাড়া দেখিনি। নানা রকম নল ও যন্ত্রের কারণে কথা বলতে পারত না, কিন্তু মিষ্টি হাসি দিয়ে চোখের ইশারায় ভাব প্রকাশ করত। আর সে গভীরভাবে বিশ্বাস করত, সে সেরে উঠবে।

এর মধ্যে গাইনি বিশেষজ্ঞ, ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, আইসিইউ বিশেষজ্ঞসহ আরও কনসালট্যান্টরা যুক্ত হয়েছেন তাঁর চিকিৎসায়। সবাই অবাক হয়েছেন তাঁর আত্মবিশ্বাস আর মনের জোর দেখে। ৯ দিন পর থেকে ভেন্টিলেটর খুলে দেওয়ার ট্রায়াল শুরু হলো। ১১ দিনের দিন পুরোপুরি খুলে দেওয়া হলো সব যন্ত্রপাতি। রুকসানা সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেন। অবশেষে ২৩ অক্টোবর তিনি ফিরে এলেন নিজের বাসায়। আসার আগে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন তাঁর গর্ভস্থ শিশুটি সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। পরবর্তী সময়ে ফলোআপে যেতে হবে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত।

রুকসানা বললেন, ‘আমি ভয় পাইনি। কখনোই মনোবল হারাইনি। আর চিকিৎসক, নার্স ও অন্য কর্মীরা এত সাহায্য করেছেন, এত সাহস জুগিয়েছেন যে নিজেকে কখনো অসহায় বা একা মনে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার সন্তান ভালো আছে, যতবার এটা শুনতাম, ততবারই আমি নতুন করে লড়াই করার প্রেরণা পেতাম।’

রুকসানার চিকিৎসক ডা. রাশেদুল হাসানও বলেন, ‘খুব সাহসের সঙ্গে লড়েছেন রুকসানা। কখনোই ভেঙে পড়েননি। যতবারই আমরা কাছে গেছি, বুড়ো আঙুল পেটের দিকে ইশারা করে তিনি জানতে চেয়েছেন তাঁর বাচ্চা কেমন আছে। বাচ্চা ভালো আছে শোনার সঙ্গে সঙ্গেই উজ্জ্বল হয়ে উঠত তাঁর মুখ। রুকসানা যেদিন আইসিইউ থেকে বেরিয়ে আবার কেবিনে যান, সেদিনটা সত্যি স্মরণীয়। এমন অপার আনন্দ আর তৃপ্তি অনেক দিন আমরা পাইনি।’