বিশ্বব্যাপী যেসব মরণব্যাধি আছে, সেগুলোর ভেতর ক্যানসার অন্যতম। ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’র ২৭তম পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘লিভার ক্যানসারের চিকিৎসা’। প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি দেখানো হয় এই অনুষ্ঠান। এদিন অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অনকোলজিস্ট এবং জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. মো. মোয়াররফ হোসেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডা. মো. শাহরিয়ার ইসলাম।
শুরুতেই অধ্যাপক ডা. মো. মোয়াররফ হোসেন বলেন, লিভার একট ছোট আকারের ফুটবলের মতো গ্রন্থি। পেটের ওপরের দিকে ডান পাশে পাকস্থলির ওপরে থাকে। লিভারে কোনো সমস্যা হলে পেটের উপরিভাগের ডান দিকে ব্যথা শুরু হয়। লিভার ক্যানসারকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটার উৎপত্তি লিভারেই। এটাকে আমরা বলি হেপাটোসেলুলার বা প্রাইমারি লিভার ক্যানসার। আর অপরটির উৎপত্তি লিভারের বাইরে। যেমন ফুসফুস, কিডনি বা পাকস্থলিতে। অন্য জায়গা থেকে লিভারে এসে বাসা বাঁধা এই ক্যানসারকে আমরা সরাসরি লিভার ক্যানসার বলি না। বলি মেটাস্টিলিক লিভার ক্যানসার।
হেপাটোসেলুলার বা প্রাইমারি লিভার ক্যানসারের কারণ
হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসের যথাযথ চিকিৎসা না করে থাকলে বা ভ্যাকসিন না দিলে সেটা লিভারে প্রদাহ হয়ে একসময় ক্যানসার আকারে দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া এই ক্যানসারের আরেকটা কারণ অ্যালকোহল। আমাদের দেশে লোকে অ্যালকোহল কম খায়। কিন্তু বিদেশে লিভার ক্যানসারের অন্যতম কারণ অ্যালকোহল সেবন। লিভার ক্যানসারের সঙ্গে দুটো বিষয় জড়িত। হেপাটাইটিসের চিকিৎসা না করা, ওজন বেড়ে যাওয়া, অ্যালকোহল সেবন। এসব ছাড়া গ্রামে দেখা যায় অনেক দিন ধরে খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করা হয়। ফলে এর ওপর একধরনের ফাঙ্গাস জমে; যা লিভারের ওপর বিষক্রিয়া করে সেখান থেকে ক্যানসারের সৃষ্টি করতে পারে। ধূমপানের সঙ্গেও লিভার ক্যানসারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশে লিভার ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব
বিশ্বে প্রতিবছর ৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এর ভেতর ৮০ ভাগ ধরা পড়ে একদম শেষ পর্যায়ে। এতে প্রায় ৭ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব।
লিভার ক্যানসারের লক্ষণ ও চিকিৎসা
লিভার ক্যানসার দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। শতকরা ১৫ থেকে ২০ জনের প্রাথমিক অবস্থায় লিভার ক্যানসার ধরা পড়ে। টিউমারের আকার ছোট, পাঁচ সেন্টিমিটারের কম থাকলে, টিউমারের সংখ্যা কম থাকলে, একটা, দুটো বা তিনটা থাকলে, এমন অবস্থায় রোগীর লিভার ও ভাস্কুলার ইনভেশন যদি ভালো থাকে, সে ক্ষেত্রে অনেকে কেবল অপারেশনে সুস্থ হয়ে ওঠেন। আবার এর চেয়ে একটু ক্রিটিক্যাল অবস্থা হলে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টও করা যায়। মানে রোগীর লিভার সরিয়ে সেই জায়গায় অন্য একটা লিভার বসিয়ে দেওয়া। এই পদ্ধতি ১৯৪৭ সালে শুরু হয়েছিল।
এখনো চলে আসছে। লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য যদিও লিভার পাওয়া খুব মুশকিল। তবে আমরা যদি সার্জারিতে ৬০% লিভারও ফেলেও দিই, বাকি লিভারের টিস্যু নিজে থেকেই পুরোপুরি রিজেনারেট করতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় সফলভাবে ডায়াগনোসিস হলে ৫ থেকে ১০ বছর সুস্থ থাকতে পারবেন। লিভার ক্যানসার থেকে সুস্থ ব্যক্তিরা করোনার টিকা নিতে পারবেন। এতে কোনো অসুবিধা হবে না।
যাঁদের লিভার ক্যানসার ৮০% ছড়িয়ে পড়েছে, আমরা চেষ্টা করি তাঁর কষ্ট কমাতে। তিনি যেন আরেকটু বেশি দিন বাঁচেন, সেই চেষ্টা করতে। ছড়ানোর মাত্রা আর হারটা কমিয়ে দিতে। ব্লাড ভেসেলগুলো সক্রিয় করে দেওয়া হয়। এই ব্লাড ভেসেলগুলো লিভারে পুষ্টি সরবরাহ করে। ফলে লিভারটা একটু কার্যকর হয়। সমস্ত টেস্ট, কেমোথেরাপি, মাইক্রোওয়েভ থেরাপি, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন (আরওফএ)— লিভার ক্যানসারের যত চিকিৎসা আছে, তার সবই বাংলাদেশে দেওয়া হয়।
লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসার এক নয়। তবে যাঁদের লিভার সিরোসিস হয়, তাঁদের লিভার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
লিভার ক্যানসার ঠেকাতে করণীয়
হেপাটাইটিসের টিকা নেওয়া। যাঁরা নেননি, তাঁদের লিভার ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেশি। অ্যালকোহল, ধূমপান, ফ্যাটি ফুড বাদ দিতে হবে। স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার খেতে হবে। লিভারে যেন চর্বি না জমে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উত্তরবঙ্গে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তারা অনেক দিন খাদ্যশস্য রেখে দেয়। ফলে ক্ষতিকর ফাঙ্গাস পড়ে। এটা লিভারের জন্য বিষ। বাদাম, গম, বেশি দিন রেখে খাওয়া যাবে না।