স্ট্রোকের উন্নত চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে

পৃথিবীতে যে রোগে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুহারও সর্বোচ্চ, তার নাম স্ট্রোক। দিন বদলেছে, স্ট্রোকের চিকিৎসাও উন্নততর হয়েছে। স্ট্রোকের উন্নত চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই সম্ভব।

স্ট্রোকের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয় এসকেএফ নিবেদিত ‘স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসায় অন্তরক্তনালীয় মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক বিশেষ অনুষ্ঠানে।

ডা. নাদিয়া নিতুলের সঞ্চালনায় গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন ডা. শিরাজী শাফিকুল ইসলাম (উপরে ডানে) ও অধ্যাপক, ডা. শরীফ উদ্দিন খান (নিচে)

ডা. নাদিয়া নিতুলের সঞ্চালনায় গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন ডা. শিরাজী শাফিকুল ইসলাম, স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজিস্ট এবং সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল এবং ডা. শরীফ উদ্দিন খান, অধ্যাপক, নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল ও প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোইন্টারভেনশন।

ডা. শিরাজী শাফিকুল ইসলাম বলেন, স্ট্রোক মূলত মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগ। স্ট্রোক মূলত দুই প্রকার। একটি ইস্কেমিক স্ট্রোক, যা রক্ত নালিতে ক্লট বা জমাট বাঁধার কারণে হয়। অন্যদিকে যদি রক্তনালি ছিঁড়ে যায়, ছড়িয়ে পড়া রক্তগুলো মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করে এবং মস্তিষ্কে ঠিকমতো রক্ত পৌঁছায় না, তাকে আমরা বলি হেমোরেজিক স্ট্রোক। মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি মূলত রক্তনালির ভেতরে জমাট বাঁধা রক্ত সরিয়ে দেওয়ার চিকিৎসা। যাতে রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, স্বাভাবিক প্রবাহ অব্যাহত থাকে এবং যেসব জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছে না, তা সরিয়ে দেওয়া যায়।

ডা. শিরাজী শাফিকুল ইসলাম

ফলে মস্তিষ্ক রক্ত, নিউট্রিশন ও অক্সিজেন পায়। মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি পদ্ধতির মাধ্যমে প্রথমে মস্তিষ্কে এনজিওগ্রাম করা হয়। তারপর যে সব জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে, সেখানে একটি টিউব নিয়ে যাওয়া হয় এবং ক্ষুদ্র জালিকার সাহায্যে ক্লটটিকে শোষণের মাধ্যমে বের করে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশে এই চিকিৎসা আগে ছিল না। ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি ও ব্রেনের এনজিওগ্রাম বিষয়গুলো ডেভেলপমেন্টের কারণে বাংলাদেশেই এই চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে।

ডা. শরীফ উদ্দিন খান বলেন, ‘বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করেন স্ট্রোক হৃৎপিণ্ডের রোগ, যা একটি ভুল ধারণা। স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ এবং এর চিকিৎসা শুরু হয়েছিল প্রায় এক বা দেড় দশক আগে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে চালু হয়।

ডা. শরীফ উদ্দিন খান

আমাদের জন্য নতুন হলেও মেডিকেল থ্রম্বেক্টমি মেডিকেল সায়েন্সের অনেক পুরোনো বিষয়, যা পৃথিবীজুড়ে রেডিওলজিস্টরা পরিচালনা করেছেন। বাংলাদেশে পদ্ধতিটি নিয়ে এসেছেন নিউরোলজিস্টরা এবং সফলভাবে কাজও করছেন। এ পদ্ধতিতে পায়ের রগের মাধ্যমে সরু একটি তার বা ক্যাথেডার প্রবেশ করিয়ে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে জমাট বাঁধা রক্ত বের করে নিয়ে আসা হয়। স্ট্রোক করে সম্পূর্ণ অবশ হয়ে অপারেশন টেবিলে শুয়ে থাকা রোগী একটু পরই স্বাভাবিকভাবে হাত তুলে ফেলছেন, এই চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই সম্ভব হচ্ছে।’

স্ট্রোকের লক্ষণগুলো কী কী? এই প্রশ্নের উত্তরে ডা. শিরাজী শাফিকুল ইসলাম জানান, স্ট্রোকের লক্ষণগুলোকে এফএএস নামে অভিহিত করা যায়। এফ হলো ফেস, যদি কারও মুখ একদিকে বেঁকে যায়। এতে বোঝায় আর্ম, অর্থাৎ হাত-পা অবশ হয়ে যায়। আর এস দিয়ে বোঝায় স্পিচ, অর্থাৎ রোগী স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না, জিব অবশ হয়ে আসে।

হয়তো রাতে স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে গেছেন, সকালে উঠে দেখলেন হাত-পা অবশ হয়ে আছে। টেবিলে কিছু রাখতে গেছেন, হাত অবশ হয়ে হাত থেকে জিনিসপত্র পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কথা জড়িয়ে আসছে, মাথায় কথাটা আছে, কিন্তু মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। হঠাৎ খেয়াল করলেন মুখ বারবার একদিকে বেঁকে যাচ্ছে। এই ছোট ছোট লক্ষণগুলো দেখলেই মনে করবেন, আপনার স্ট্রোকের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই লক্ষণগুলো কিছুদিন পরপর প্রকাশ হতে থাকে, আবার চলে যায়। আমরা মনে করি, ভালো হয়ে গেছে আর তখনই ভুল হয় এবং বড় ধাক্কাটি আসে।

ডা. শরীফ উদ্দিন খান বলেন, নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ, যেমন ব্লাডপ্রেশার, ডায়াবেটিস, ব্লাড কোলেস্টেরল, স্মোকিং ও অলস জীবনযাপনের কারণে রক্তনালির ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধে। কোনো কোনো সময় হার্টে ক্লট তৈরি হয়, হার্ট ঠিকমতো রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং থ্রম্বাসটি ব্রেনের রক্তনালিতে চলে যায়। ব্রেনের কোষগুলো এতটাই স্পর্শকাতর যে দুই থেকে পাঁচ মিনিটের ভেতর এই কোষগুলোতে অক্সিজেন না পোঁছালে কোষগুলো মারা যায় এবং তার ফাংশন বন্ধ হয়ে উপসর্গগুলো আসতে থাকে। তাই আমরা বলি, ব্লাডপ্রেশার এবং ডায়াবেটিস ৮০-৯০ শতাংশ স্ট্রোকের ক্ষেত্রে কাজ করে।

সুস্থ জীবনযাপন ও নিয়মমাফিক চেকআপ করলে স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। আর স্ট্রোক হয়ে গেলে মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমির মতো উন্নত চিকিৎসা নিতেই হবে।
করোনার কারণে রক্তজমাট বাঁধার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা গেছে, করোনা ভালো হওয়ার পরও এই প্রক্রিয়া থেকে যায় এবং স্ট্রোকের আশঙ্কা বাড়ে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা রক্ত পাতলা করার কিছু ওষুধ দেন, যা করোনা ভালো হওয়ার পরও চালিয়ে যেতে হয়। তবে তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, নতুবা রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে।