হঠাৎ যখন, জীবন দহন...

সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ। সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম
ছবি: সৌরভ দাশ

ফেসবুকে লাইভ চলছে। পর্দায় দাউদাউ আগুন। যে তরুণ এই লাইভ করছিলেন, তিনি হয়তো ক্ষুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেনি এই আগুনেই তাঁর মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। মুহূর্তেই একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিভে যেতে পারে তাঁর জীবনের আলোটুকু।

মর্মান্তিক ঘটনাটি সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। এখন পর্যন্ত এই দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবে ৪১ জনের এবং অনেক মানুষের হতাহতের সংবাদ পাওয়া গেছে। এই সর্বগ্রাসী আগুনের বিরুদ্ধে খুব সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। এর মধ্যে কয়েকজন মারাও গেছেন বীরত্বের সঙ্গে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরাও বিরামহীন লেগে আছেন আহত মানুষের সেবায়; রাতদিন এক করে হলেও যদি একটি প্রাণ বাঁচানো যায় এই আশায়। ঝুঁকিপূর্ণ কিছু রোগীকে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে, আরও পাঠানোও হচ্ছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট একযোগে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের মাধ্যমে চেষ্টা করে যাচ্ছে পুড়ে যাওয়া রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ও চিকিৎসকেরা যেভাবে নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, সেটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তারপরও এটাই সত্য, এই দুর্ঘটনায় অনেক মানুষের প্রাণ আমরা হারাতে যাচ্ছি এবং এই ক্ষতির কোনোভাবেই আর কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না।

তাই এ ধরনের দুর্ঘটনা কীভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে, সেটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার গুরুত্ব আরেকবার ভয়াবহভাবে দেখা দিয়েছে। যদিও এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যায়নি সীতাকুণ্ডের একই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত কীভাবে ঘটেছিল, তবু চলুন, আজ আলোচনা করি সাধারণ কিছু ভুল নিয়ে, যা আমরা প্রায়ই করে থাকি এবং যা থেকে ঘটে যেতে পারে ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনা।

* আমরা সবাই জানি, ধূমপান মৃত্যু ঘটায়। তবে সেই মৃত্যু আরও ত্বরান্বিত হতে পারে, যদি ধূমপান শেষে জ্বলন্ত সিগারেটের অন্তিম অংশটুকু দায়িত্ব নিয়ে না নেভানো হয়! জ্বলন্ত অংশটা এখানে সেখানে ছুড়ে ফেলা হয়।

* আচ্ছা, মশার কয়েল যে আমরা জ্বালাই, সে ক্ষেত্রে আমরা কতজন মানুষ তা বুঝে শুনে সাবধানতার সঙ্গে সেটাকে রাখি? অথচ দেখেন, এই সামান্য মশার কয়েলের আগুনও কিন্তু বাধাতে পারে ভয়ংকর কোনো অগ্নিকাণ্ড চোখের পলকেই।

* ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, তার, প্লাগ অনেক সময় ব্যবহার করতে থাকি, আলসেমির কারণে পরিবর্তন করা হয় না। অথচ এসব সরঞ্জাম থেকেও কিন্তু ধরে যেতে পারে সর্বগ্রাসী অগ্নিকাণ্ড।

* শীতকালে দেশের অনেক জায়গাতেই আগুন পোহানোর একটি ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস প্রচলিত আছে। অথচ প্রতিবছর কত মানুষ শুধু এই ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাসের কারণে মারা যাচ্ছেন, তা জানতে আপনাকে অবশ্যই শীতকালে বার্ন ইউনিটে এসে একবার দেখে যেতে হবে।

* অনেক সময়ই বিভিন্ন সংস্কৃতি কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে আমরা নির্বিচার প্রদীপ, মোমবাতি, মশাল ইত্যাদি জ্বালাই। সেখান থেকেও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

* রান্নার জন্য আগুন তো লাগবেই, কিন্তু সেই আগুনের ব্যবস্থা কি নিরাপদভাবে করা হচ্ছে? কোনো জ্বলন্ত বস্তু এদিক–সেদিকে আগুন লাগাচ্ছে না তো?

* অত্যাধিক দাহ্য পদার্থ কি যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে রাখা হচ্ছে? কোনো দাহ্য তরল বা গ্যাসীয় কোথাও লিক হচ্ছে কি?

* শেষটাও করছি সেই ধূমপান দিয়েই। টয়লেটে বসে কেউ ধূমপান করছে না তো?
এ রকম ছোট ছোট অনেক ভুল থেকেও ঘটতে পারে ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড। এর বাইরে আরও অনেক কারণ তো আছেই।

লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা

আপনার সামনে যদি কোথাও আগুন ধরেই যায়, তবে আপনি কী করবেন
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আপনাকে যে কয়টা বিষয় অবশ্যই জানতে হবে, তা হলো আগুনের ধরন, আগুনের ব্যাপ্তি, যা পুড়ছে তা কী ধরনের পদার্থ।

যদি কোনো মানুষের গায়ে আগুন লাগে, তবে সবার আগে তাকে তো উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। যদি ছোটখাটো কোনো অগ্নিকাণ্ড হয়, তবে আগে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়ে, তারপর আশপাশের সবাইকে নিয়ে অবশ্যই সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে হবে।

যদি খুব বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যদি আগুন ছড়িয়েই যায়, তবে ফায়ার সার্ভিসকে নেতৃত্ব দিতে দিন এবং সাধারণ মানুষ তাদের বিভিন্নভবে সাহায্য করুন। এ ক্ষেত্রে পেশাদার মানুষের বদলে আমজনতা নেতৃত্ব দিলে বিপদ বাড়ার আশঙ্কা যথেষ্টই আছে।

যে কয়টা জিনিস কখনোই করতে নেই, তার মধ্যে অন্যতম হলো আগুনের সামনে টিকটকের ভিডিও করা, এটা শুধু অমানবিকই না, প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণও। এ ছাড়া আগুনের কাছে গিয়ে ভিডিও করা বা লাইভ করাও একেবারেই অনুচিত।

যাঁরা আগুন নেভানোর চেষ্টায় কিংবা একটি প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় মৃত্যুবরণ করেছেন, নিঃসন্দেহে সেই মৃত্যু গৌরবের। কিন্তু যাঁরা কৌতূহল থেকে আগুনের কাছে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন, সেই সংখ্যাটাও একেবারে কম না। তাই আমরা আরেকটু সচেতন হই, দায়িত্বশীল হই। চলুন আরেকটু ভালোভাবে ভেবে দেখি, আমার দিক থেকে কোনো গাফিলতি নেই তো?

লেখক: প্লাস্টিক সার্জন ও বার্ন বিশেষজ্ঞ, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, ঢাকা।