সাক্ষাৎকার
‘দেশ থেকে প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল করতে চাই’
যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক ইফতিখার মাহমুদ। মাতৃস্বাস্থ্য, নবজাতক, প্রসবজনিত ফিস্টুলা নিয়ে গবেষণা করেছেন। জন্মস্থান কক্সবাজারে গড়ে তুলেছেন হোপ ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটি ফিস্টুলায় আক্রান্ত নারীদের সেবা দিয়ে থাকে। জুনে দেশে এসেছিলেন তিনি। তখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিশির মোড়ল
প্রশ্ন :
প্রসবজনিত ফিস্টুলা কী
প্রসবের সময় কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়, প্রসব বাধাগ্রস্ত হয়। জরায়ুমুখের কাছে শিশুর মাথা আটকে যায়। মায়ের গর্ভেই শিশু মারা যায়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে প্রজনন অঙ্গের টিস্যু নষ্ট হয়ে যায়, অনেক সময় টিস্যু পচে যায়। ফলে প্রস্রাবের থলি ও মাসিকের রাস্তা যুক্ত হয়ে যায়। এটাই ফিস্টুলা। তখন প্রস্রাবের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না, অনেক ক্ষেত্রে পায়খানার ওপরও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রস্রাব অনবরত ঝরতে থাকে। যত দিন যায়, পরিস্থিতি তত খারাপের দিকে যেতে থাকে। নারীর শরীর থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে।
প্রশ্ন :
বৈশ্বিকভাবে ফিস্টুলার প্রকোপ কেমন, বাংলাদেশে সমস্যাটি কত বড়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, সারা বিশ্বে প্রায় ২০ লাখ নারী ফিস্টুলার শিকার। আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোতে ফিস্টুলার প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের মাতৃস্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৯ হাজার নারী এই সমস্যায় আক্রান্ত। পাশাপাশি প্রতিবছর এক হাজার নারী প্রসবজনিত সমস্যার কারণে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
প্রশ্ন :
সামাজিকভাবেও কেন ফিস্টুলা রোগীকে হেয় হয়ে থাকতে হয়
ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীর সঙ্গে দুর্গন্ধ জড়িয়ে থাকে। এর প্রথম ধাক্কাটি লাগে দাম্পত্য সম্পর্কে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্পর্ক ভেঙে যায়, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ওই নারী একা হয়ে পড়েন। অতি আপনজনও ওই নারীর কাছে আসতে চান না। স্বামীর বাড়িতে হোক বা বাবার বাড়িতে হোক, তাঁকে অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় জীবন কাটাতে হয়। গোয়ালঘরে থাকতে হচ্ছে—এমন নজিরও আছে। তীব্র লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীর জীবন কাটে।
প্রশ্ন :
ফিস্টুলার কী চিকিৎসা আছে
চিকিৎসার আগে কীভাবে ফিস্টুলা প্রতিরোধ করা সম্ভব, তা নিয়ে ভাবতে হবে। গর্ভধারণের পর থেকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অপরিহার্য। প্রসব–পূর্ববর্তী স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফলে একধরনের সামঞ্জস্য থাকে। অস্বাভাবিক কিছু দেখা দিলে চিকিৎসক তা গর্ভবতী মাকে অবহিত করে থাকেন। কোথায় প্রসব হবে, তার প্রস্তুতি থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতাল বাড়ি থেকে দূরে থাকে। এসব ক্ষেত্রে প্রসব ব্যথা উঠলে গর্ভবতী নারীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। হাসপাতালে বা ক্লিনিকে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর হাতে প্রসব করাতে হবে।
তারপরও গর্ভে কোনো শিশু মারা গেলে প্রসূতি মাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসায় তাঁর সুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। এ ছাড়া আছে শল্য চিকিৎসা। কক্সবাজারের হোপ হাসপাতালে ফিস্টুলার সার্জারি হয়। দেশে আরও কয়েকজন শল্য চিকিৎসক আছেন।
প্রশ্ন :
দেশে ফিস্টুলা নিয়ে কী কাজ হচ্ছে
ফিস্টুলার ব্যাপারে সরকারের একটি কৌশলপত্র আছে। ২০১৬ সালে সরকার এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্সও করেছিল। সরকার ফিস্টুলা নিয়ে কাজ করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়।
বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ফিস্টুলা নিয়ে কাজ করে। এর মধ্যে আছে ম্যাপস (ঢাকা), কুমুদিনী হাসপাতাল (টাঙ্গাইল), হোপ (কক্সবাজার), ল্যাম হাসপাতাল (দিনাজপুর), আদ্-দ্বীন হাসপাতাল (ঢাকা)। এ ছাড়া সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফিস্টুলার সার্জারি হওয়ার কথা।
প্রশ্ন :
ফিস্টুলা রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যা আপনার চোখে পড়েছে
বড় সমস্যা হচ্ছে রোগী খুঁজে বের করা। কে রোগী, এটা চিকিৎসকের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। অনেকে লুকিয়ে রাখেন। আবার অনেকে জানেন না এর চিকিৎসা কোথায় পাওয়া যায়। আমরা দেখেছি, রোগীর সঙ্গে কে হাসপাতালে আসবে, এমন লোক পাওয়া যায় না।
প্রশ্ন :
নারী বা মাতৃস্বাস্থ্যের আরও অনেক বিষয় থাকতে কাজের ক্ষেত্র হিসেবে ফিস্টুলা বেছে নিলেন কেন
১৯৯৯ সালে আমি কক্সবাজার এলাকায় একটি ক্লিনিক চালু করি। সেই ক্লিনিক পরে কক্সবাজার এলাকায় হোপ হাসপাতাল নামে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করে। ২০১০ সালে ওই হাসপাতালে কাজ করতে দুই সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে একজন ধাত্রী এসেছিলেন। হাসপাতালে কাজের সময় ও গ্রামে ঘুরে তিনি জানতে পারেন, কক্সবাজার এলাকায় বহু নারী ফিস্টুলায় আক্রান্ত। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আমাকে বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করেন। পরে বুঝেছি ও জেনেছি যে এটি শুধু কক্সবাজার এলাকার সমস্যা নয়, বাংলাদেশের বহু নারীই ফিস্টুলায় আক্রান্ত।
পরে আমি যুক্তরাষ্ট্রের ফিস্টুলা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ফিস্টুলা নিয়ে কাজ করার জন্য ওই ফাউন্ডেশন আমাকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেয়।
শুরুতে চিকিৎসক পাওয়া ছিল বড় সমস্যা। নৃন্ময় বিশ্বাস নামের একজন চিকিৎসক আগ্রহ নিয়ে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ফিস্টুলার সার্জারিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য দুই মাসের জন্য তাঁকে আফ্রিকাতে পাঠিয়েছিলাম। আমরা এখন নিয়মিত ফিস্টুলার চিকিৎসা করি।
প্রশ্ন :
আপনার গবেষণা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের একটি বড় এলাকা মাতৃস্বাস্থ্য
১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাই। কর্নেল ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজ থেকে শিশুস্বাস্থ্যের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিই। ১৯৯৬ সাল থেকে আমি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করি। শিশুর রোগ চিকিৎসাই ছিল আমার পেশা। কিন্তু আমার জন্ম কক্সবাজারে। কক্সবাজার এলাকায় নারীস্বাস্থ্যের দুরবস্থা আমি শৈশব থেকেই দেখেছি। আমি তা ভুলিনি। নারীস্বাস্থ্যের বিষয়ে আমার আগ্রহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়েও ছিল। অন্যদিকে নবজাতক বা শিশুস্বাস্থ্যের সঙ্গে মাতৃস্বাস্থ্যের সম্পর্ক আছে। শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতি করতে হলে মাতৃস্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার পেছনে প্রধান কারণ এ দুটি।
প্রশ্ন :
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী
হোপ কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলায় ফিস্টুলা নিয়ে কাজ করছে এক দশকের বেশি। কিন্তু দেশের সব জেলায় ফিস্টুলা নিয়ে কাজ হয় না। আমরা বরিশাল বিভাগে হোপ হাসপাতালের কাজ সম্প্রসারণ করব। কক্সবাজারে ফিস্টুলা নিয়ে একটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছি। দেশে হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন বা হাসপাতাল ফিস্টুলা নিয়ে কাজ করছে। এদের সব কটিকে নিয়ে একটি মোর্চা গড়ে তোলা সম্ভব হলে ফিস্টুলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি বাড়বে। আমরা সেটা গড়ে তুলব। এর মাধ্যমে দেশ থেকে প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল করতে চাই।