স্তন ক্যানসারে যে পরীক্ষা খুব জরুরি

‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠান

বাংলাদেশের নারীরা যেসব ক্যানসারে বেশি আক্রান্ত হন, সেগুলোর মধ্যে স্তন ক্যানসার শীর্ষে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৫ হাজারের বেশি মানুষ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন, যার ৯৮ শতাংশই নারী। তাই নারীদের নিজের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সচেতন হতে হবে স্তন ক্যানসার নিয়ে।

অক্টোবর ‘স্তন ক্যানসার সচেতনতা’র মাস। এ উপলক্ষে এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড আয়োজিত ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় এমন মতামত উঠে আসে। এ পর্বে আলোচনা হয় ‘স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে বাংলাদেশ’ বিষয়ে। অনুষ্ঠানটি গতকাল শুক্রবার সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. মহিউদ্দিন মাতুব্বর। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউিট ও হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগ) ডা. সিনথিয়া আফরিন।

আলোচনার শুরুতে ডা. স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় দর্শকদের জানান স্তন ক্যানসার কী, কখন একজন মানুষ বুঝবেন তিনি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন এবং বাংলাদেশে এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। স্তনের ভেতরে যখন বিকৃত কোষের উপস্থিতি দেখা যায় এবং তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়, তখন স্তনের ভেতরে চাকা দেখা যায়। এ রকমটা হলে স্তন ক্যানসার হয়েছে বলে ধারণা করতে হবে। চাকা ছাড়াও স্তনের আকার বা আকৃতির পরিবর্তন, স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত বা তরল পদার্থ বের হওয়া, স্তনবৃন্তের আশপাশে র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি, বগলে ফুলে যাওয়া বা চাকা দেখা দেওয়া, স্তনের ভেতরে গোটা ওঠা বা শক্ত হয়ে যাওয়া—এ বিষয়গুলোও খেয়াল রাখতে হবে।

স্তন ক্যানসার কি শুধু নারীদেরই হয়? এ ক্যানসারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বয়স কত? সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, স্তন ক্যানসার নারী-পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। তবে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে নারীরই হয়ে থাকে। আর সাধারণত ৩৫ বছর বয়সের পর থেকেই এই রোগে আক্রান্তের হার বেশি। তবে পারিবারিকভাবে যাঁদের এই রোগ থাকে, তাঁদের বয়স ৩০–এর আগেও দেখা যায়।

স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন অধ্যাপক ডা. মো. মহিউদ্দিন মাতুব্বর। তিনি বলেন, স্তন ক্যানসার হয়েছে কি না, নির্ণয় করার জন্য বাংলাদেশের সব হাসপাতালেই ব্যবস্থা আছে। দরকার শুধু সচেতনতা। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করা। নারীরা মাসিক শুরু হওয়ার দশম দিনের পর নিজে নিজে দেখবেন কোনো রকম চাকা অনুভূত হয় কি না। এই পরীক্ষা খুব জরুরি।

নির্ণয়ের পদ্ধতি নিয়ে ডা. মো. মহিউদ্দিন মাতুব্বর আরও জানান, যখন সন্দেহ হবে, তখনই স্তন আলট্রাসনোগ্রাফি করাতে হবে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে স্তনের ভেতরের চাকার ভেতরের পদার্থ ঘন না তরল, সেই ব্যাপারে একটা ধারণা করা যায়। আর আছে ম্যামোগ্রাম। এটি একধরনের বিশেষ এক্স–রে, যা চিকিৎসকদের স্তন ক্যানসার নির্ণয়ে সাহায্য করে। বয়স যখন ৫০ হবে, তখন একজন নারীকে প্রতিবছর এই পরীক্ষাগুলো জরুরি ভিত্তিতে করাতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং মৃত্যুঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনে। যাঁদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রে আরও আগে স্ক্রিনিং শুরু করা জরুরি। যেমন পরিবারে যদি কারও অল্প বয়সে স্তন ক্যানসার হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করে যথাসময়ের আগেই স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং শুরু করে দিতে হবে।

স্তন ক্যানসার কি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য? কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যায়? এ বিষয়ে ডা. স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রতিটি ক্যানসারের চারটি ধাপ থাকে। স্টেজ ওয়ান ও টু হলো প্রাথমিক ধাপ। এই সময়ের মধ্যে কোনো রোগী যদি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং চিকিৎসা শুরু করেন, তাহলে এই রোগ পুরোটাই নিরাময়যোগ্য হবে। কিন্তু পরবর্তী স্টেপগুলোতে চিকিৎসাটা অপারেশনের পর্যায়ে পড়ে যায়, কিছুটা জটিল হয়ে যায়। তাই প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এসব সমস্যায় নারীরা পুরুষ চিকিৎসকের কাছে যেতে অস্বস্তি বোধ করেন। এটা কাটিয়ে উঠতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসনের ক্ষেত্রে বলব, বাংলাদেশে অনেক নারী চিকিৎসক আছেন, আপনারা তাঁদের শরণাপন্ন হন। তারপরও প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নিন।’

দেশে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসাসেবা নিয়ে কথা বলেন ডা. মো. মহিউদ্দিন মাতুব্বর। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। রাজধানীতেই প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস। সেই তুলনায় হাসপাতাল কম। আমাদের প্রতিটি হাসপাতালে এই চিকিৎসাসেবা আছে। কিন্তু অতিরিক্ত মানুষের চাপে সঠিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলায় অভাব দেখা যায়। একটু শৃঙ্খলা, স্বস্তি ও পরিচ্ছন্নতার জন্যই অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যান। ক্যানসার চিকিৎসা বিশ্বব্যাপী একই ধরনের। একই গাইডলাইন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমি বলব, স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা দেশেই সম্ভব এবং অন্যান্য দেশের তুলনায় কম খরচেই সম্ভব।’