শরীরে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড জমলে মৃত্যুও হতে পারে, জেনে নিন প্রতিকার

শ্বসনতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা পরিবেশ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করি। শরীরের কোষগুলোর বিপাকীয় কাজে লাগে এ অক্সিজেন। এ প্রক্রিয়ায় বর্জ্য হিসেবে তৈরি হয় কার্বন ডাই-অক্সাইড। শ্বসনতন্ত্রের মাধ্যমে এটাকে আমরা পরিবেশে ছেড়ে দিই। শ্বসনতন্ত্র মূলত এ অক্সিজেন গ্রহণ আর কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। কোনো কারণে শ্বসনতন্ত্র যদি এ ভারসাম্য রক্ষায় ব্যর্থ হয়, তাহলে শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না, কার্বন ডাই-অক্সাইডও ঠিকঠাক নির্গমন হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ পরিস্থিতিকে বলে ‘রেসপিরেটরি ফেইলিওর’। যদি শুধু অক্সিজেন সরবরাহে কিংবা ব্যবহারে সমস্যা হয়, তাহলে একে ‘টাইপ ওয়ান রেসপিরেটরি ফেইলিওর’ আর যদি অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড উভয়ের ব্যবহারে কিংবা নির্গমনে সমস্যা হয়, তাহলে একে ‘টাইপ টু রেসপিরেটরি ফেইলিওর’ বলা হয়।

অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড জমার কারণ

ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের কারণে শরীরে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড জমতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সিওপিডি’ বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, যা মূলত ধূমপান ও পরিবেশদূষণের কারণে হয়ে থাকে।

ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের কারণে শরীরে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড জমতে পারে
ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়া ‘ওবেসিটি হাইপোভেন্টিলেশন সিনড্রোম’ সমস্যা স্থূলকায় ব্যক্তিদের বেশি হয়ে থাকে। বুকের পাঁজর ও কশেরুকার জন্মগত রোগ, যেমন পেকটাস কেরিনেটাম/স্ক্যাভেটাম কিংবা কাইফোস্কোলিওসিস (বক্ষদেশীয় কশেরুকা সামনে কিংবা পাশে হেলে পড়া) প্রভৃতি কারণেও এ সমস্যা হয়ে থাকে। এ ছাড়া স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ, যেমন মায়োপ্যাথি (শরীরের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়া), নিউরোপ্যাথি (স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়া), মস্তিষ্কের যে অংশ আমাদের শ্বসনপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, সে অংশে কোনো সংক্রমণ, টিউমার বা স্ট্রোক হলেও শরীরে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড জমতে পারে। মোটকথা, দীর্ঘমেয়াদি যেকোনো ফুসফুসের রোগে রক্তে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমতে পারে।

কার্বন ডাই-অক্সাইড অতিরিক্ত বেড়ে গেছে কি না, তা জানতে চিকিৎসকেরা ‘আর্টেরিয়াল ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইসিস’ নামের একটি পরীক্ষা করেন। সাধারণত, ধমনিতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পার্শ্বচাপ ৩৫ থেকে ৪৫ মিলিমিটার মার্কারি। এটি ৪৫-এর বেশি হলে আমরা ধরে নিই শরীরে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড জমছে। অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড জমায় ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়। একপর্যায়ে অতিরিক্ত কার্বন ডাই–অক্সাইড জমার কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

কীভাবে বুঝবেন

সাধারণত, শরীরে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড জমলে আক্রান্ত ব্যক্তির যেসব লক্ষণ দেখা যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

১. মাথাব্যথা।

২. মাথা ঝিমঝিম ও দিনে অতিরিক্ত তন্দ্রা ভাব। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় যাকে বলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নারকোসিস।

৩. হাত–পা কাঁপতে থাকা।

৪. হাত–পা ঘামে ভিজে যাওয়া।

৫. আবদ্ধ নাড়ির উচ্চগতি।

৬. পা ফুলে যাওয়া।

চিকিৎসা ও প্রতিকার

প্রধান চিকিৎসা হলো যে রোগের কারণে শরীরে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমছে, তার যথাযথ চিকিৎসা। আমাদের দেশে সিওপিডি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ রোগই রেসপিরেটরি ফেইলিওরের প্রধান কারণ। এ রোগ থেকে বাঁচতে ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। সিওপিডি রোগীদের চিকিৎসকের পরামর্শ মতো নিয়মিত ইনহেলার ব্যবহার করতে হবে। ওজন বেশি থাকলে কমাতে হবে। পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, নিয়ম করে ব্যায়াম করতে হবে। শরীর থেকে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করার জন্য ‘বাই প্যাপ’ মেশিন নামক একটি যন্ত্র আছে। নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে শ্বসন–উত্তেজক ওষুধ (যেমন অ্যালমিট্রিন ও রাউবাসিন, মেড্রোক্সি-প্রোজেস্টেরন) ব্যবহার হয়ে থাকে। এসব চিকিৎসা ব্যর্থ হলে রোগীকে মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনে (কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা) রাখা হয়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রেসপিরেটরি মেডিসিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়