শিশুদের স্মার্টফোন আসক্তির এই ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা জানতেন?

গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের স্মার্টফোনে আসক্তির কারণ মূলত সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সময় না কাটানো, খেলার মাঠের অভাব, খেলার সাথির অভাব, স্মার্টফোনে কার্টুন দেখা, স্মার্টফোনে গেম খেলা ইত্যাদি
ছবি: পেক্সেলস ডটকম

শিশুদের আগে গল্প বা ছড়া শুনিয়ে খাবার খাওয়ানো ও কান্না থামানো হতো। এই কাজগুলোই এখন মোবাইলে গান চালিয়ে কিংবা কার্টুন দেখিয়ে করা হয়। এভাবে আস্তে আস্তে শিশুরাও স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সর্বাধুনিক মডেলের মোবাইল ফোনও এখন কারও সাহায্য ছাড়াই চালাতে পারে শিশুরা। অতিপ্রয়োজনীয় এই স্মার্টফোনের অপব্যবহারে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন নানা জটিলতা।

বর্তমানে বিশ্বের ৯২ শতাংশ লোকের হাতে মোবাইল ফোন আছে। এর ভেতর ৩১ শতাংশ কখনোই তাদের ফোন বন্ধ করে না। বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ সময়ের প্রায় ৩ গুণ। চলতি বছর বাংলাদেশে শিশুদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশের মারাত্মক স্মার্টফোন আসক্তি রয়েছে। অন্যদিকে মাত্র ১৪ শতাংশ শিশু অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে। আরও দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন মায়ের ৪ জনই সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তি সম্পর্কে অবগত নন।

স্মার্টফোন আসক্তির কারণ

গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের স্মার্টফোনে আসক্তির কারণ মূলত সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সময় না কাটানো, খেলার মাঠের অভাব, খেলার সাথির অভাব, স্মার্টফোনে কার্টুন দেখা, স্মার্টফোনে গেম খেলা ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইল, সামাজিক যোগাোযগমাধ্যম ও ইন্টারনেট গেম আসক্তি অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তির মতোই। ভার্চ্যুয়াল এন্টারটেইনমেন্ট দেখার সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের কোষ থেকে ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরিত হয়। এই ডোপামিন আমাদের মনে ভালো লাগার অনুভূতি সঞ্চার করে। আসক্তি তৈরি করে।

স্মার্টফোন আসক্তির ক্ষতিকর প্রভাব

১. আজকের শিশুরা রেডিয়েশন ঘেরা এক পরিবেশের মধ্যে বড় হচ্ছে। শিশুদের মস্তিষ্ক ইলেকট্রনিকস পণ্য থেকে নির্গত ক্ষতিকর তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণের প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। বড়দের তুলনায় শিশুদের মস্তিষ্ক প্রায় দ্বিগুণ এবং অস্থিমজ্জা প্রায় দশ গুণ বেশি বেতার তরঙ্গ শোষণ করে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, তাদের মস্তিষ্ক ও কানে নন-ম্যালিগন্যান্ট টিউমার হওয়ার উচ্চতর আশঙ্কা থাকে।


২. মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে চোখের রেটিনা, কর্নিয়া এবং অন্যান্য অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে মায়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যা। এই রোগের কারণে চোখে যন্ত্রণা ও  মাথাব্যথায় ভোগে শিশুরা, ক্লাসের পেছনে বসলে সামনের বোর্ড স্পষ্ট দেখতে পায় না। ইদানীং খুব অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের চশমা ব্যবহার করতে দেখা যায়।


৩. মোবাইল ফোনের ডিসপ্লেতে থাকা অগণিত জীবাণু সহজেই শিশুদের শরীরে প্রবেশ করে, কমিয়ে দেয় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। এ ছাড়া তাদের মৃগীরোগ ও হাঁপানি রোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।


৪. স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চারা অনেক রকম শারীরিক সমস্যা, যেমন মাথাব্যথা, হাত ও পিঠে ব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য, অনিয়মিত খাওয়া, স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।


৫. কিশোরদের সামনের প্যান্ট পকেটে মোবাইল ফোন রাখলে শুক্রাণু কমে যেতে পারে। কিশোরী মেয়েরা পোশাকের ভেতরে ফোন রাখলে স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি আছে।


৬. এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চাদের ঘন ঘন মেজাজ বদলে যায়। কারণ ছাড়াই রেগে যাওয়া, অপর্যাপ্ত এবং অনিয়মিত ঘুম, অমনোযোগিতা, ভুলে যাওয়া, ভাষার দক্ষতা বিকাশ না হওয়া এবং ভাইবোন, বাবা-মা ও খেলার সাথিদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাসহ বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হয়।


৭. ভবিষ্যতে আমাদের শিশুরা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তারা নিজেদের সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলবে। ঘরকুনো স্বভাবের হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হবে। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো অটুট রাখার দক্ষতা শিখতে পারবে না।


৮. শিশুরা অনলাইনে ভায়োলেন্স ও সাইবার বুলিংয়ের মতো অপরাধের শিকার হতে পারে, যা তাদের কোমল মনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের স্মার্টফোন দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। আপনার সন্তানকে সময় দিন। তাদের হাতে বই তুলে দিন
ছবি: পেক্সেলস ডটকম

স্মার্টফোন আসক্তি প্রতিরোধে করণীয়


১. ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের স্মার্টফোন দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। আপনার সন্তানকে সময় দিন। তাদের হাতে বই তুলে দিন। শিশুকে বাগান, পার্ক বা মাঠে খেলাধুলা করতে বা ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। পারিবারিক সম্পর্কগুলোর চর্চা বাড়াতে হবে। নিজেরা তাদের সঙ্গে খেলুন। এতে তাদের মন প্রফুল্ল থাকবে, নানা বিষয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হবে। ফলে তাদের মেধা বিকশিত হবে, ভালো থাকবে শরীরও।


২. আপনার শিশু যখন ফোনে কথা বলে, তখন তারযুক্ত হেডসেট ব্যবহার করতে শেখান।


৩. শিশুদের আশপাশে বড়রা সীমিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করুন। শিশুকে স্কুলে বা শোবার ঘরে ফোন নিতে দেবেন না।


৪. পড়াশোনার জন্য শিশুদের যদি স্মার্টফোন দিতেই হয়, তাহলে স্মার্টফোনে পড়াশোনার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় তৈরি করুন। নজর রাখুন।

৫. শিশুদের টিভি কিংবা মোবাইলে স্ক্রিন টাইম যেন এক ঘণ্টার বেশি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন।


৬. শিশুদের ঘরের কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। সন্তানকে ছোট ছোট কাজে সহযোগিতা করতে শেখান। এতে শিশুরা ঘরের কাজের প্রতি আগ্রহী হবে। মোবাইল আসক্তি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসবে।


৭. প্রি-স্কুল বাচ্চাদের স্মার্টফোন ব্যবহারের জন্য একটি নির্দেশনাবলি তৈরি করে সেই অনুযায়ী কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করা প্রয়োজন।
 
ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন এমডি গবেষক-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা