চুলা বন্ধ করে আসতে আসতে মনে হয়, চুলাটা বন্ধ করিনি—এই সমস্যার সমাধান কী
পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট রউফুন নাহার নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।
প্রশ্ন
আমি অনেক দিন ধরে কিছু মানসিক সমস্যায় ভুগছি। ধরুন, আমার আম্মু কোনো গোপন কথা আমাকে জানিয়ে বলল, কথাটা যেন কাউকে না বলি। কিছুক্ষণ পর আমার মনে হয়, আমি ওই কথাগুলো সবার কাছে বলে দিয়েছি। তারপর চিন্তা করি, আম্মুর সঙ্গে তো সমস্যা বেধে যাবে।
পড়াশোনার ব্যাপারে আমার বন্ধুরা কোনো নোট বা শিটের প্রয়োজন হলে মেসেঞ্জার গ্রুপে নোটগুলো আমাকে দিতে বলে। মাঝেমধ্যে নোটগুলো আমার সেন্ট করতে মনে থাকে না! পরে ওরা আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘তুমি তো নোট দিলে না।’ তখন আমার মনে হয়, আমি তো দিয়েছি অথচ দিইনি।
গ্যাসের চুলা বন্ধ করে আসতে আসতে মনে হয়, আমি চুলাটা বন্ধ করিনি।
আমি যখন পড়তে বসি, তখন আমার মাথায় আজেবাজে উল্টাপাল্টা চিন্তা আসে। মনে হয়, আমি কাউকে মেরেছি কি? কাউকে গালি দিইনি তো? এ কারণে আমার সমস্যা হতে পারে। এসব কারণে আমি পড়তে বসে দুশ্চিন্তা করতে থাকি।
দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা মোকাবিলা করছি আমি। কিন্তু এখন আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা। পড়তে বসলেই এসব চিন্তা এসে আমার মাথায় ভর করছে। আমি অনেক চেষ্টা করছি নিজেকে বোঝানোর, তবু আমার মনকে শান্ত করতে পারছি না।
আমি ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে পারছি না। সব মিলিয়ে আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। আমি কীভাবে এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাব, অনুগ্রহ করে জানাবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর
ধন্যবাদ আপনার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে এত সুন্দর করে গুছিয়ে লেখার জন্য। আপনি নিজে সমস্যাটি বুঝতে পারছেন এবং উত্তরণের জন্য চেষ্টা করছেন, এটি খুব ইতিবাচক একটি ব্যাপার।
আপনার সঙ্গে যা হচ্ছে, তা অনেকটাই অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারের (ওসিডি) উপসর্গের সঙ্গে মিলে যায়। এটি একটি মানসিক সমস্যা, যেখানে একজন ব্যক্তির একই চিন্তার পুনরাবৃত্তি ঘটে বা দীর্ঘসময় একই চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকেন (অবসেশন) ও বাধ্যতামূলক কিছু আচরণ করেন (কমপালশন), অর্থাৎ যা থেকে বিরত থাকা ব্যক্তির সাধ্যের বাইরে চলে যায়।
অবসেশন নানা কিছু নিয়ে হতে পারে, যেমন জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার দুশ্চিন্তা। ফলে অতিরিক্ত পরিচ্ছন্নতা, কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ বা খুঁতখুঁতে ভাব, ভয়ংকর বা অস্বস্তিকর কোনো চিন্তা বারবার আসা ইত্যাদি।
কমপালশন বলতে বোঝায়, অবসেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো কাজ বারবার করা। যেমন হাত ধোয়া, কোনো কিছু করার পর তা ঠিকমতো হলো কি না, বারবার পরীক্ষা করা, জিনিসপত্র অতিরিক্ত গুছিয়ে রাখা, সবকিছু নিখুঁতভাবে করার প্রবণতা ইত্যাদি।
অবসেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত কাজ বা আচরণ বারবার করার মাধ্যমে সাময়িক একটা স্বস্তি পাওয়া গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে এটি মানসিক চাপ বাড়ায় এবং ব্যক্তিকে অবসাদগ্রস্ত করে ফেলে।
যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে ওসিডি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সে ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়মিত সেশন নিতে হয়। তীব্র মাত্রার ওসিডি হলে ওষুধেরও প্রয়োজন হয়। ওষুধ মূলত মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলে সেরোটোনিন নামের নিউরোট্রান্সমিটারসহ বিভিন্ন ব্রেন কেমিক্যালের যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, সেগুলোকে ভারসাম্য রাখতে সহযোগিতা করে।
বংশগত ও পরিবেশগত কারণ, শৈশবে মানসিক আঘাত বা ট্রমা, দৈনন্দিন জীবনে মানসিক চাপ ইত্যাদি নানা কারণে ওসিডি হতে পারে। মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনার জন্য মেডিটেশন, শরীরচর্চা, পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম খাদ্য, জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবসম্মত রুটিন তৈরি করে কাজ করা দরকার।
আপনার জন্য আরও দরকার কাজের অগ্রগতি খেয়াল রাখা, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা সামলে রাখার কৌশল শেখা। এ ক্ষেত্রে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতাও প্রয়োজন। ধৈর্য ধরে চিকিৎসা ও ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখলে ধাপে ধাপে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়। আপনার জন্য শুভকামনা।
পাঠকের প্রশ্ন বিশেষজ্ঞের উত্তর
জীবনযাপনে নানা বিষয়ে নানা রকম প্রশ্ন জাগে মনে। অনেক সমস্যাও তৈরি হয়, যা সবার কাছে বলা যায় না। স্বাস্থ্য, মন, সম্পর্ক, সন্তানপালন, খাদ্যাভ্যাস, ডায়েট, আইন–অধিকার—এসব বিষয়ে যেকোনো প্রশ্ন পাঠাতে পারেন প্র অধুনায়। ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে আপনার প্রশ্নের উত্তর বা সমস্যার সমাধান দেবেন খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞরা। পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।
ই–মেইল ঠিকানা: [email protected] (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন: মন/আইন/স্বাস্থ্য’)
ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন: মন/আইন/স্বাস্থ্য’)
ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA