অনেক মানুষ আছে নতুন কারও সঙ্গে কথা বলতে যারা নার্ভাস বা মানসিক চাপ বোধ করে। কথায় জড়তা চলে আসে, কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, বন্ধুর জন্মদিন, কারও বিবাহবার্ষিকী বা পুনর্মিলনীতে অনেক মানুষের মধ্যে কথা বলতে গেলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, গলা শুকিয়ে যায়, হাত-পা কাঁপতে থাকে, হাত ও পায়ের তালু ঘেমে যায় ও বুক ধড়ফড় করে। এই যন্ত্রণার কথা কাউকে সে বলতেও পারে না।
এই মানুষেরা যে সমস্যায় আক্রান্ত তাকে বলে সোশ্যাল ফোবিয়া বা সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার। এটি একটি মানসিক রোগ, যা যেকোনো বয়সেই হতে পারে। তবে কিশোর বয়স বা বয়ঃসন্ধিকালে এটি বেশি দেখা যায়। কিশোরদের চেয়ে কিশোরীদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
কীভাবে বুঝবেন
অনেকে একটু বেশি মাত্রায় লাজুক হতে পারে, এ ধরনের মানুষেরা লাজুকতার কারণে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। তারা সামাজিকভাবে মিশতে পারে না বা হীনম্মন্যতায় ভোগে। লাজুক স্বভাব একটি ব্যক্তিত্বের ধরন, যা কোনো মানসিক রোগ নয়। অনেক সমাজ লাজুক স্বভাবকে ইতিবাচকভাবেই মূল্যায়ন করে। উল্টো দিকে সোশ্যাল ফোবিয়া বা সামাজিক ভয়ের কিছু নির্দিষ্ট উপসর্গ আছে। চলুন, দেখে নিই—
সামাজিক অনুষ্ঠানে বা এ রকম পরিস্থিতিতে মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা ভয় হয়। মনে হয় অন্যরা সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার ভুল বা খুঁতগুলো দেখছে।
অন্যরা নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করবে বা তিরস্কার করবে।
লজ্জিত বা অপমানিত হব, এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে।
অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে বা খাওয়াদাওয়া করতে গেলে বা বক্তব্য দিতে গেলে অতিরিক্ত ভয় বা দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করে।
মনে হয় আমার আচরণের কারণে অন্যরা আমাকে এড়িয়ে চলছে বা আমার সঙ্গে মিশছে না।
অনেক সময় সামাজিক অনুষ্ঠান বা ভিড়ভাট্টা থেকে নিজেদের দূরে রাখে। আর যদি বা সেখানে যায় তাহলে খুব ভয় বা দুশ্চিন্তা নিয়ে অবস্থান করে, নিজেকে লুকিয়ে রাখে এবং পারতপক্ষে কম কথা বলে।
সোশ্যাল ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি খুব চুপচাপ হয়ে যায়, চোখে চোখ রেখে কথা বলে না, নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে।
সোশ্যাল ফোবিয়ার ক্ষেত্রে অনেক ধরনের শারীরিক উপসর্গও থাকে, যেমন হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা, মুখমণ্ডল লাজুক ও লাল হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, গলা শুকানো, ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ, এমনকি রক্তচাপও বেড়ে যেতে পারে।
সামাজিক ভয় কেন হয়
১. জিনগত কারণ: শৈশব ও কৈশোরে ব্যক্তিত্বের ধরনের কারণে অনেক ছেলে-মেয়ে ভিতু ও চুপচাপ প্রকৃতির হয়। এই ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অপ্রীতিকর পরিবেশ বা কারও কোনো নেতিবাচক কথায় বিব্রতকর পরিবেশ এড়ানোর প্রবণতা বেশি থাকে। ব্যক্তিত্বের ধরন থেকে পরবর্তী সময়ে সামাজিক ভয় রোগ বা সোশ্যাল ফোবিয়া হতে পারে। আত্মীয়স্বজনের কারও মধ্যে ‘সামাজিক ভয়’ রোগ থাকলে এই রোগ হওয়ায় প্রবণতা দেখা যায়।
২. পরিবেশগত কারণ: বন্ধুদের দ্বারা খারাপ আচরণ, টিটকারি, সমালোচনা বা বুলিংয়ের স্বীকার হলে পরবর্তী সময়ে সামাজিক ভয় রোগ হতে পারে।
অতিরিক্ত সোশ্যাল স্ট্যান্ডার্ড বা সামাজিক মান সবসময় মানসিক চাপ তৈরি করে, ফলে সামাজিক পরিবেশে কাজ করতে গেলে বেশি দুশ্চিন্তা তৈরি হয় এবং দুশ্চিন্তা থেকে অনেক শারিরিক ও মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়। ভয় ও দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে ধীরে ধীরে সে সামাজিক পরিবেশ এড়িয়ে চলে। এভাবে সামাজিক ভয় বা সোশ্যাল ফোবিয়া তৈরি হয়।
জাতিগত বিভেদ ও বৈষম্য, ভেদাভেদ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সামাজিক ভয় রোগের কারণ হতে পারে।
৩. মনস্তাত্ত্বিক কারণ: সামাজিক পরিবেশে নিজের কাজ অতিমাত্রায় পর্যবেক্ষণ করা, নেতিবাচক চিন্তা বারবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনে আসা ও নিজের সম্পর্কে বারবার নেতিবাচক চিন্তা করাও মানসিক চাপ বাড়ায় যা সোশ্যাল ফোবিয়ার কারণ।
সামাজিক কোনো ঘটনায় ভয় বা দুশ্চিন্তার পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা অগ্রিম ভয় সৃষ্টি করে যা শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ তৈরি করে, দেখা দেয় সোশ্যাল ফোবিয়া।
৪. স্নায়ুজনিত কারণ: জনপরিসরে কথা বলতে গেলে অ্যামিগডালা (মস্তিষ্কের যে অংশ ভয় ও দুশ্চিন্তার মতো আবেগগুলো নিয়ন্ত্রণ করে), হিপ্পোক্যাম্পাস (মস্তিষ্কের যে অংশ কিছু মনে রাখার জন্য কাজ করে) ও ইনসুলা (মস্তিষ্কের যে অংশ ব্যথা বেদনা বা অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে) বেশি উত্তেজিত হয়ে স্নায়ুজনিত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, অপর দিকে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে (ব্যক্তিত্বের প্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ও সামাজিক আচরণের মতো ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে) প্রতিক্রিয়া কমে যায়। এপিনেফ্রিন (হৃৎস্পন্দন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে) ও নরএপিনেফ্রিন নিউরোট্রান্সমিটার সোশ্যাল ফোবিয়ায় বেড়ে যায়। পক্ষান্তরে ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করে।
সামাজিক ভয়ের চিকিৎসা
এই রোগের চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু করা যায় তত ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এই রোগের দুই ধরনের চিকিৎসা রয়েছে—ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা (সাইকোথেরাপি) ও ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা।
সাইকোথেরাপি: সোশ্যাল ফোবিয়ায় কগনেটিভ বিহেভিয়র থেরাপি প্রাথমিক কার্যকর চিকিৎসা। রোগীর ভুল, মিথ্যা ধারণা ও ভ্রান্তিকর চিন্তাগুলো কগনিটিভ বিহেভিয়র থেরাপির মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করা হয়। সাইকো এডুকেশন (রোগী ও রোগীর পরিবারকে রোগ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে হবে), এক্সপোজার থেরাপি, সাইকো ডাইনামিক সাইকোথেরাপি এই রোগে ভালো কাজ করে।
ওষুধ: রোগী যদি সাইকোথেরাপিতে সুস্থ না হয় বা মধ্যম বা তীব্র মাত্রায় উপসর্গ দেখা দিলে ওষুধ দিতে হয়। সোশ্যাল ফোবিয়ায় অনুমোদিত অনেক কার্যকর ওষুধ আছে যা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে নিতে হবে।
সোশ্যাল ফোবিয়া বা সামাজিক ভীতি একটি রোগ হিসেবে দেখতে হবে এবং একে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা নিলে আক্রান্ত ব্যক্তি পরে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা