থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা নিতে গিয়ে যেভাবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মী হয়ে উঠলেন রনি ইসলাম
কুষ্টিয়ার সন্তান মো. রনি ইসলাম। জন্ম ১৯৯৬ সালে। কাছের মানুষেরা তাঁকে মিঠুন নামে ডাকেন। ছোটবেলায় অন্যদের চেয়ে একটু ফ্যাকাশে দেখাত তাঁকে। মনে হতো, মেজাজটা বেশ খিটখিটে। আর কোনো সমস্যা ছিল না। হঠাৎ একবার ভীষণ জ্বর। শরীরখানা হলুদ হয়ে গেল। বয়স তখন সাত বছর। সেই সময়ের ছোট্ট রনি কিংবা তাঁর পরিবার জানত না, কী কঠিন রোগে ভুগছিলেন তিনি। জানা ছিল না, জীবন কতটা নির্মম হয়ে দেখা দেবে। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রনির জয়ী হয়ে ফেরার গল্প এটা।
কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান রনি ইসলামকে সেই সময় প্রথমে কবিরাজি চিকিৎসা করানো হয়েছিল। পরে স্থানীয় ক্লিনিকে নেওয়া হয়। ধরা পড়ে রক্তশূন্যতা। সেবারই প্রথম রক্ত নিতে হলো। বছর দুই পরে আবারও অসুস্থতা। রাজশাহীতে চিকিৎসা হয় সেবার। রক্ত নিতে হয় আবারও। এরপর প্রায়ই রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন হতে থাকে।
পড়ালেখা করে কী হবে!
ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় দারুণ আগ্রহ রনির। অসুস্থতার জন্য পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। অনেকে নেতিবাচক মন্তব্যও করতেন। রনি ইসলাম বলেন, ‘কেউ বলতেন ক্যানসার হয়েছে। কেউ উপহাস করতেন, এই শরীরে এত পড়ালেখা করে কী হবে! কেবল আমাদের প্রতিবেশী হাজী রফিকুল ইসলাম চাচা সাহস দিয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনেও যথাসাধ্য করেছেন চাচা।’ তবে সেই সময় অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়ালেখা করা হয়নি রনির। এদিকে পেটখানা বড় হয়ে যাচ্ছিল। বয়স যখন ১৭, তখন সুস্থতার আশায় জমিজমা বিক্রি করে রনির প্লীহা নামের অঙ্গটি অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেওয়া হলো।
নতুন যুদ্ধের সূচনা
পরিবারের চাপে ১৭ বছর বয়সেই বিয়ে করেন রনি। এর পর থেকে প্রতি মাসে রক্ত নিতে হতো তখন, শরীর একেবারেই ভালো নয়। কিন্তু স্ত্রীর দায়িত্বও তো অস্বীকার করা যায় না। ২০১৪ সালে প্রতিবেশী সেই চাচা রফিকুল ইসলামের সহায়তায় রনি বিক্রয়কর্মীর চাকরি শুরু করেন গাজীপুরে। পরের বছর পদোন্নতিও হয়। সেবারই কোয়ান্টামের ভ্রাম্যমাণ ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন সম্পর্কে জানতে পারেন।
সত্যের মুখোমুখি
২০১৫ সালে ঢাকায় এসে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে পৌঁছে অবাক হয়েছিলেন রনি। দেয়ালে কার্টুনের ছবি, শিশুরা রক্ত নিচ্ছে, কেউ কেউ খেলছে, আর নার্সরা গান গাইছেন। চিকিৎসাকেন্দ্র কি এমন হতে পারে! ডা. সাজিয়া ইসলাম পরীক্ষা করলেন রনিকে। জানালেন, রনিকে থ্যালাসেমিয়া রোগী বলেই মনে হচ্ছে তাঁর। রক্তের রিপোর্ট এলে নিশ্চিত হলেন, তাঁর ধারণাই ঠিক। এবার ভীষণ হতাশা গ্রাস করে নেয় রনিকে। এ এমন রোগ, যার বোঝা বইতে হবে সারা জীবন। চিকিৎসকের পরামর্শে ভাই, বোন ও স্ত্রীরও রক্ত পরীক্ষা করানো হলো। জানা গেল, রনির এক বোন থ্যালাসেমিয়া রোগী, আরেক বোন থ্যালাসেমিয়া বাহক। রনির স্ত্রীও থ্যালাসেমিয়া বাহক। তার মানে, তাঁদের সন্তান হলে তারও থ্যালাসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৭৫ ভাগ! সেই মুহূর্তে রনির মনে হয়েছিল, জীবন বড় নিষ্ঠুর। একজন মানুষ থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না, তা যে বিয়ের আগেই পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া কত জরুরি, রনি সেবারই প্রথম জানলেন। তাঁর মা-বাবা দুজনই তো দিব্যি সুস্থ। কিন্তু দুজনেই ছিলেন বাহক। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা ২৫ শতাংশ।
তবু যুদ্ধ চলে...
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে বিভিন্ন ফান্ডের মাধ্যমে রনির চিকিৎসা চলছিল। সেখানের কর্মীরা কেবল চিকিৎসাই নয়, সাহসও দিতেন। ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ডা. আবদুর রহিমের সঙ্গে পরিচয় সেখানেই। চিকিৎসার পাশাপাশি জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে অসুস্থতার কারণে রনি গাজীপুরের চাকরিটা ছেড়ে দেন, পরের বছর নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন। রনির থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ার পর থেকেই তাঁর দাম্পত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুই পরিবারে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। তবে স্ত্রী তাঁর পাশে ছিলেন সব সময়। এদিকে পোশাক কারখানার অপারেটর হিসেবে প্রায়ই বেশ রাত অবধি কাজ করতে হতো রনিকে। কখনো কাজ থাকত সারাটা রাত। শরীরে কুলাচ্ছিল না। সে বছরই আবার চাকরি ছাড়লেন বাধ্য হয়েই। এরপর কী করলেন? রনি বললেন, ‘স্ত্রীকে নিয়ে কুষ্টিয়া চলে গেলাম। রোজগারের চেষ্টায় অন্য এলাকায় গিয়ে পাট কাটা ও পেঁয়াজ তোলার মতো কাজও করেছি দিনমজুর হিসেবে। তবে অসুস্থ শরীরে সেই ধকলও সইল না। তাই ২০১৮ সালে ডা. আবদুর রহিমের সঙ্গে আবার দেখা হলে নিজের সমস্যার কথা জানালাম।’
বদলে যাওয়ার গল্প
সে বছরই ল্যাব সহকারী হিসেবে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে যোগদান করেন মো. রনি ইসলাম। বদলে যায় জীবন। ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় তাঁর ও তাঁর বোনের চিকিৎসা চলছিল। বেতনের টাকায় সাচ্ছল্যের মুখ দেখলেন। তবে বোন মারা যান ২০১৯ সালে। ওদিকে পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির চাপে রনির বিয়েটাও ভেঙে যায় পরের বছর। মানসিক আঘাত সামলে ২০২১ সালে আবার বিয়ে করেন মো. রনি ইসলাম। এবার আর বিয়ের আগে স্ত্রীর রক্ত পরীক্ষা করাতে ভুল করেননি। জীবনটা একটু স্থিতি পেলে রনির পড়ালেখার তীব্র ইচ্ছাটা আবার জেগে ওঠে। ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায়ই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পড়ালেখা শুরু করেন। ২০২৩ সালে তাঁর প্রথম কন্যা পৃথিবীর আলো দেখে। এ বছর দ্বিতীয় কন্যা জন্ম নিয়েছে। রনির সংসার এখন পরিপূর্ণ। গত বছর চাকরি ছেড়ে কুষ্টিয়া গিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসার চেষ্টা করেছিলেন। তবে সুবিধা হয়নি। ৩ মাস ১১ দিন পর আবার ফাউন্ডেশনে যোগ দেন সেখানকার ফার্মেসির বিক্রয়কর্মী হিসেবে। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও অংশ নিচ্ছেন। নিজ উদ্যোগে একটি ব্যবসাও দাঁড় করিয়েছেন। মালিবাগে গড়ে তুলেছেন আল হেরা সুগন্ধি স্টোর। সুগন্ধি ছাড়াও সেখানে পাওয়া যায় টুপি। জীবনের ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের সামনে হার না মানা মো. রনি ইসলাম স্বপ্ন দেখেন, বাংলাদেশ একদিন থ্যালাসেমিয়ামুক্ত হবে। প্রতিটি সুস্থ মানুষ বিয়ের আগে যদি জানতে পারেন, তিনি থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না, কেবল তাহলেই রনির স্বপ্ন পূরণ হবে। নতুন করে এমন ভয়াবহতায় পড়বে না আর একটি প্রাণও। আর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত মানুষের মধ্যে কারও হয়তো তাঁর এই উদ্যোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান হবে—এমনটাও আশা করেন তিনি।