গুগলে রোগবালাইয়ের চিকিৎসা খোঁজাও যখন একটি রোগ

কোনো রোগ হলেই অনেকে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে আগে অনলাইনে উপসর্গ লিখে অনুসন্ধান করে। গুগলের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করে। জানেন এতে করে ঝুঁকিতে পড়তে পারে আপনার জীবন

কোনো রোগ হলেই অনেকে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে আগে অনলাইনে উপসর্গ লিখে অনুসন্ধান করেছবি: পেক্সেলস

কয়েক দিন ধরে প্রায়ই মাথাটা ব্যথা করছে। মনে হলো, অনেক প্রশ্নের উত্তরই তো গুগলে পাওয়া যায়, এ বিষয়ে একটু সার্চ করে দেখি তো। উপসর্গ লিখে অনুসন্ধান করতেই সব কারণ, লক্ষণ বিশদভাবে তুলে ধরল গুগল। আসতে থাকল একের পর এক রোগের বর্ণনা। মাথাব্যথার একটি অন্যতম কারণ ব্রেন টিউমার—এটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার মাথায় ঢুকে গেল, নিশ্চয় ব্রেন টিউমার হয়েছে। অন্যান্য উপসর্গ পড়তে পড়তে দেখেন, আরে, সব তো মিলে যাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গেল। দুর্বল লাগতে থাকল। আতঙ্কে কোনো কাজ করতে আর ভালো লাগে না, খেতে ইচ্ছে করে না, কোনো কাজে আগ্রহ পাওয়া যায় না। ওজন কমে যাচ্ছে। নতুন সৃষ্ট সমস্যাগুলোকে আরও বেশি ক্যানসারের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে। জীবন শেষ, এই হতাশা পেয়ে বসল।

তারপর এসব সমস্যা নিয়ে আপনি চিকিৎসকের কাছে গেলেন। চিকিৎসক পরীক্ষা করে টিউমারের কোনো লক্ষণ না পেয়ে আশ্বস্ত করলেন। কিন্তু আপনি আশ্বস্ত হতে পারলেন না। আপনার দৃঢ় বিশ্বাস যে টিউমারই হয়েছে। মাথার সিটিস্ক্যান স্বাভাবিক, তাতে কী, এমআরআই করার জন্য জোর করতে লাগলেন। এমআরআইও স্বাভাবিক, কিন্তু আপনি সন্তুষ্ট নন। নিশ্চয় এই চিকিৎসক ধরতে পারছেন না, আপনি আরেক চিকিৎসকের দ্বারস্থ হলেন। এভাবে একের পর এক চিকিৎসকের কাছে যেতে যেতে আপনার দস্তা দস্তা ফাইল হয়ে গেল, কিন্তু রোগনির্ণয় হয় না। মানসিক চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদিকে বাড়ছে মাথাব্যথার তীব্রতাও। আপনার স্বাভাবিক জীবন লাটে উঠল। আপনি রীতিমতো শয্যাশায়ী। এই যে গোটা জার্নি, এটি নিজেই আসলে এক ধরনের রোগ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় হাইপোকনড্রিয়াসিস।

হাইপোকনড্রিয়াসিস কী

হাইপোকনড্রিয়াসিস হচ্ছে একধরনের মানসিক ব্যাধি, যেখানে রোগীর মনে হতে থাকে তাঁর কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি হয়েছে, কিন্তু যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এ সমস্যায় রোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের কোনো জটিল রোগে ভুগছেন বলে মনে করতে থাকেন, যেমন ক্যানসার, স্ট্রোক, স্নায়ুরোগ বা হার্টের রোগ। সচরাচর যেসব লক্ষণ দেখা যায়:

১.   কোনো একটা রোগ বা সমস্যা নিয়ে সর্বদা ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করে। সেই ভয়, আতঙ্ক থেকে শরীরে আরও ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ উপসর্গ তৈরি হতে থাকে।

২.   এই রোগীরা বারবার চিকিৎসকের কাছে সমস্যা নিয়ে যান। বারবার চিকিৎসক পরিবর্তন করেন।

৩.  শরীরে নতুন কোনো সমস্যা তৈরি হলো কি না, বারবার তা পর্যবেক্ষণ করেন। যেকোনো সমস্যা বা শারীরিক পরিবর্তনকে তাঁর মনে সৃষ্ট রোগের সঙ্গে মেলাতে থাকেন। যেমন একটু কাশি হলেই মনে করেন, ফুসফুসে ক্যানসার হয়েছে। বুকে সামান্য ব্যথা করলেই মনে হয় হার্টঅ্যাটাক করেছে বা চোখের পাপড়ি, মাংসপেশি একটু কাঁপলেই ভাবেন স্ট্রোক করেছে।

৪.   চিকিৎসকেরা আশ্বস্ত করলেও মাথা থেকে দুশ্চিন্তা সরাতে পারেন না বা কিছুদিন আশ্বস্ত হলেও কয়েক দিন পর আবার ফিরে আসে দুশ্চিন্তা।

৫.   চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে নানা রকমের পরীক্ষা করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন, যেমন সিটিস্ক্যান, এমআরআই, কোলনোস্কপি, এন্ডোস্কোপি। একটা করার পর আরেকটা করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। অনেক সময় চিকিৎসক কথা না শুনলে আরেক চিকিৎসকের কাছে একই অনুরোধ করতে থাকেন।

৬.   অনেকেই ওই রোগ বা সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেন ও পড়াশোনা করেন। গুগলে সার্চ করেন। একে-ওকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেন ও তথ্য নিতে চেষ্টা করেন।

৭.   চিকিৎসা নেওয়ার চেয়ে রোগনির্ণয়ের ব্যাপারে তাঁরা বেশি আগ্রহী থাকেন। চিকিৎসকেরা তাঁর দুশ্চিন্তা দূর করার উপায় বাতলে দিলেও রোগী তা গ্রহণ করতে আগ্রহী হন না। এই ব্যক্তিরা সব সময় মনে করেন, কোনো না কোনো একটি পরীক্ষা করা বাকি আছে, যা তাঁর রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম হবে। আসল রোগটি এখনো ধরা পড়েনি, তাই ওষুধ খেয়ে লাভ নেই।

গুগলের কারণে আমাদের অনেক কাজ সহজ হয়ে গেছে
ছবি: পেক্সেলস

গুগলের সঙ্গে এই প্রবণতার সম্পর্ক

গুগলের কারণে আমাদের অনেক কাজ সহজ হয়ে গেছে। কাজ ও পড়াশোনা সম্পর্কিত যেকোনো তথ্যের জন্য আমরা প্রথমে গুগলেরই শরণাপন্ন হই। এর প্রতি আমাদের মধ্যে একধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। আমাদের অনেকের বিশ্বাস, যেকোনো সমস্যার সমাধান গুগল দিতে পারে, তবে সবক্ষেত্রে এটা ঠিক না। গুগল অনেক সমস্যার বিশদ বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করে। আপনি যেভাবে জানতে চাইবেন, সেভাবে আপনাকে তথ্য প্রকাশ করে। যেমন চিকিৎসার ব্যাপারে গুগল একটি রোগে যত রকমের লক্ষণ হতে পারে, তার সবই বর্ণনা করে। তার কোনো একটার সঙ্গে আপনার বর্তমান সমস্যা মিলে যেতেই পারে। তার মানে এই নয় যে রোগটি আপনার হয়ে গেছে।

একজন চিকিৎসক বিস্তারিত ইতিহাস জেনে, সম্পূর্ণ শারীরিক পরীক্ষা করে এবং প্রয়োজনে কিছু ল্যাব পরীক্ষা করে তবেই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন। গুগল কিন্তু তা করে না। সে সবার জন্য একই পদ্ধতিতে পরামর্শ দিতে চেষ্টা করে। এখানেই সমস্যা। যত বেশি এ বিষয়ে সার্চ দিতে থাকেন, তত বেশি বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।

এটি কাদের বেশি হতে পারে

  • যাঁরা যেকোনো সমস্যা নিয়ে অনেক বেশি দুশ্চিন্তা করেন বা ওভারথিঙ্কিং করেন।

  • যাঁরা খুঁতখুঁতে স্বভাবের হোন।

  • অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এ রোগীদের আত্মীয়স্বজনদের কেউ ওই দুরারোগ্য রোগে মারা গেছেন বা অসুস্থ আছেন। সেই আতঙ্ক তার মধ্যেও চেপে বসেছে।

  • শৈশবে যাঁরা বড় ধরনের অসুখে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের কারও কারও সেই পুরোনো মানসিক ধকল থেকে এ রকম সমস্যা মনের মধ্যে বাসা বাঁধে।

করণীয়

এ ধরনের রোগী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে তার ভয়াবহ কোনো রোগ হয়েছে। কেউ বোঝানোর চেষ্টা করলে বরং বিরক্ত হন। অনেক সময় আপনজনেরা অবহেলা বা উপেক্ষা করছেন, যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে রেগে যান। কোনোভাবে বুঝতে চান না যে এটি একটি মানসিক রোগ। অনেকে চিকিৎসকের কাছে যেতে আগ্রহী হলেও তাঁকে কোনো মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলে সন্দেহ করেন বা ক্রুদ্ধ হন। এ ধরনের রোগীর আশপাশের মানুষদের সহনশীলতা ও সহানুভূতি প্রয়োজন। এই রোগীদের পাশে মানসিকভাবে দাঁড়ানো জরুরি। কারণ, তাঁরা মানসিকভাবে খুব ভঙ্গুর হয়ে থাকেন। তাকে বোঝাতে হবে এটি একটি সাধারণ সমস্যা। এ রকম সমস্যা অনেকেরই হয়। বোঝাতে হবে, মনোরোগবিদ, থেরাপিস্ট বা সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হলে সমাধান হতে পারে।

এই রোগীদের বিভিন্ন সাইকোথেরাপি চিকিৎসা আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে এ ধরনের অযাচিত দুশ্চিন্তা দূর করা সম্ভব।

প্রথমত, অসুস্থতা সম্পর্কিত যেসব অযাচিত চিন্তা মাথায় আসে বা যে সমস্যা বা রোগটি দুশ্চিন্তা বাড়ায়, সেটিকে চিহ্নিত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বারবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া বা বারবার ইন্টারনেটে ঢোকা বা গুগলে সার্চ করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।

তৃতীয়ত, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে, যাতে এ ধরনের চিন্তা মাথায় না আসে। যেমন মাথায় দুশ্চিন্তা ভর করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অন্য কাজে ব্যস্ত করে ফেলতে হবে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের লোকজন ও বন্ধুবান্ধব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

এ ছাড়া জীবনযাত্রার কিছু সহজ পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকাংশে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। যেমন নিয়মিত হাঁটাচলা ও ব্যায়াম করা, সঠিক সময়ে ঘুমানো, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ। বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থা বা সাপোর্ট গ্রুপ আছে, যারা এ ধরনের সমস্যা কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, তার প্রশিক্ষণ দেয়। এসব সংস্থায় এ রকম আরও ভুক্তভোগী থাকেন, যাঁদের সঙ্গে সমস্যা ভাগাভাগি করেও মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে গুগলসহ আরও নতুন নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে সব ধরনের তথ্য আমাদের হাতের মুঠোয়। গুগলে অনেক নির্ভরযোগ্য সাইট যেমন আছে, তেমিন অনেক ভুল তথ্যও থাকে। মিসইনফরমেশন বর্তমান যুগের একটি বড় সমস্যা। তাই ইন্টারনেটে কোনটা গ্রহণ করতে হবে বা কোন পর্যায় পর্যন্ত এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, সেটা জানা খুব জরুরি।