বড় বড় কোম্পানির সিইওদের গড় আয়ু কম কেন?

করপোরেট দুনিয়ায় কাজের অসহনীয় চাপ নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। কিছুদিন আগেই ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটা প্রতিবেদন ব্যাপক আলোচনায় আসে। গত এক বছরে বিশ্বের শীর্ষ ৫ হাজার কোম্পানির ১ হাজার ৯ শতাধিক মানুষ সিইও পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে গেছেন। এক বছরে ১৯ জন সিইও অফিসে কর্মরত অবস্থায়ই মারা গেছেন। আর যাঁরা চাকরি না ছেড়ে কাজ করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে শতকরা ৯৬ ভাগের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে।

বেশি চাপে থাকা বড় কোম্পানির সিইওরা কম চাপে থাকা সিইওদের চেয়ে গড়ে দুই বছর কম বাঁচেনপ্রতীকী ছবি: পেক্সেলস

করপোরেট দুনিয়ায় এই সংস্কৃতি নিয়ে ঢাকঢাক গুড়গুড় বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিল। কান পাতলেই শোনা যেত সিইওদের মানসিক দুরবস্থার কথা। এবার সেই আগুনে আরেকটু ঘি ঢেলে দিয়ে ন্যাশনাল ব্যুরো অব একাডেমিক রিসার্চ তুলে এনেছে ভয়ংকর এক তথ্য। বেশি চাপে থাকা বড় কোম্পানির সিইওরা শুধু মানসিকভাবেই অবসাদগ্রস্থ থাকেন না, বরং তাঁরা কম চাপে থাকা সিইওদের চেয়ে গড়ে দুই বছর কম বাঁচেন! কাজ, সাফল্য আর মুনাফার মূল্য দেন জীবন দিয়ে। এমনকি কোম্পানি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জে পড়লে তাঁরা দ্রুত বুড়িয়ে যান, চেহারায়ও পড়ে বয়সের ছাপ।

কেন এমন হয়?

এ প্রশ্নের উত্তর আসলে আমাদের সবারই জানা। দীর্ঘ সময় চাপের মধ্যে থেকে কাজ করা, কম ও অনিয়মিত ঘুম, কাজের চাপে খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো না করা, ব্যায়াম ও শরীরচর্চা করার সুযোগ না পাওয়া ইত্যাদি কারণ আমাদের জানা। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?


এত এত প্রতিযোগিতার মধ্যে টিকে থাকার জন্য দিন দিন কাজের চাপ যেমন বাড়ছে, তেমনি এটা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে শান্তির ঘুম। সেটা দিয়েই শুরু! এমনকি আমাদের জীবনও চলে যাচ্ছে সিইও হতে গিয়ে। কাজেই, খুব বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের সিইও হওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি আসলে জীবনে কী চান? প্রেশার কুকারের মধ্যে থেকেও আকাশসম নির্ঘুম সফলতা? নাকি ছোট্ট কোনো ব্যবসা করে স্বস্তির একটা নির্ভেজাল জীবন?

এখন প্রশ্ন হতে পারে, ছোট কোম্পানির সিইওরা কি তবে খুব শান্তিতে থাকে? বা চ্যালেঞ্জ একেবারেই থাকে না? উত্তর হলো, থাকে। ছোট ব্যবসা সামলাতেও আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু তবু চাপের পরিমাণ থাকে অনেক কম। কেননা, কোম্পানির সঙ্গে চাপ সমানুপাতিক।

গবেষণা বলছে, বিশ্রামই আপনাকে দুই বছর বেশি বাঁচতে সাহায্য করবে
প্রতীকী ছবি: পেক্সেলস

বিশ্বাস না হলে বেইলর ইউনিভার্সিটির করা একটা গবেষণায় চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। এই গবেষণায় দেখা গেছে, নিজের ছোট্ট ব্যবসার সিইওরা, অর্থাৎ ছোটখাটো উদ্যোক্তারা তুলনামূলক স্বাস্থ্যকর, পারিবারিক ও সুখী জীবন যাপন করেন। এমনকি কর্মচারীদের তুলনায় তাঁদের চিকিৎসকের কাছে যেতে হয় কম, জীবন নিয়ে তাঁদের সন্তুষ্টি থাকে বড় প্রতিষ্ঠানের সিইওদের চেয়ে বেশি।

এখনো বুঝতে কষ্ট হলে আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, আপনি বিরাট একটা প্রতিষ্ঠানের সিইও। আপনার অধীনে এক লাখ লোক কাজ করেন। এই সব কাজের দেখভাল, ব্যবসা সম্প্রসারণ, ভোক্তাদের দিকটা সামলে নিয়ে আবার ব্যবসা সম্প্রসারণ, সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি মিনিট আপনাকে কতটা পাহাড় সামলাতে হবে, বুঝতে পারছেন? এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নজরদারি তো আছেই, পান থেকে চুন খসলেই আপনাকে তার জবাবদিহি করতে হবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।


এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণত লক্ষ্য ঠিক করা থাকে। সেই লক্ষ্য অর্জনে আপনাকে নিরলস কাজ করে যেতে হবে। আপনি ঘুমাতে পারলেন কি পারলেন না, সেটা নিয়ে ভাবার সময় কই? অন্যদিকে আপনি যখন নিজের ছোট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন, তখনো কর্মী বা ভোক্তাদের চাপ থাকে। তবে সেই চাপের নিয়ন্ত্রণ থাকে আপনার নিজের কাছেই। আপনি চাইলেই কাজ একটু কম করে ছুটি একটা দিন বেশিই নিলেন, কার কী এল গেল?

এই স্বস্তি বা আরাম করার স্বাধীনতাটুকুর মূল্য আপনার কাছে কম মনে হতেই পারে। কিন্তু গবেষণা থেকে আমরা দেখি, এই আপাত বিশ্রামই আপনাকে দুই বছর বেশি বাঁচতে সাহায্য করবে, মুক্ত রাখবে মানসিক ও শারীরিক অনেক রোগবালাই থেকেও।


বড় কোম্পানির সিইও হতে চাওয়া খারাপ কিছু নয়, বরং ক্যারিয়ারের জন্য সেরা সিদ্ধান্ত। সাফল্যের উচ্চাভিলাষ কার না থাকে! থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা যেন সাফল্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে পরিবার, প্রিয়জন এমনকি নিজেকেও হারিয়ে না ফেলি।


তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল