নিজের অজান্তেই পা নাচাচ্ছেন তো? জেনে নিন এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

মানুষ নানা অভ্যাসের দাস। যেমন কেউ আঙুলের নখ খোটে, কেউ অজান্তেই নিজের চুল ছেঁড়ে, কেউবা হাতে থাকা কলম কামড়ায়। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটিকে বদভ্যাস বললেও ভুল হবে না। এত সবের মধ্যে খুবই পরিচিত একটি অভ্যাস বসে বসে পা নাচানো। আমাদের অনেকেই এই বদভ্যাসের নিয়মিত চর্চাকারী। বিশেষ করে আমরা যখন উদ্বেগ বোধ করি, তখন এটি বেশি হয়। কিন্তু এমনটি আমরা কেন করি?

শরীর ও মস্তিষ্কের রোগাক্রান্ত অবস্থার একটি ছোট্ট বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে পা নাচানোছবি: পেক্সেলস

মানুষ নানা অভ্যাসের দাস। যেমন কেউ আঙুলের নখ খোটে, কেউ অজান্তেই নিজের চুল ছেঁড়ে, কেউবা হাতে থাকা কলম কামড়ায়। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটিকে বদভ্যাস বললেও ভুল হবে না। এত সবের মধ্যে খুবই পরিচিত একটি অভ্যাস বসে বসে পা নাচানো। আমাদের অনেকেই এই বদভ্যাসের নিয়মিত চর্চাকারী। বিশেষ করে আমরা যখন উদ্বেগ বোধ করি, তখন এটি বেশি হয়। কোথাও বসে থাকা অবস্থায় কিছুটা নিজের অজান্তেই যেন পা নড়তে থাকে। কেউ কেউ তো এত জোরে পা নাচান যে শব্দে আশপাশের মানুষজনও বিরক্ত হন। না চাইলেও অবচেতনভাবে কখনো এক পা, আবার কখনো দুই পা-ই নাচান অনেকে। কিন্তু এমনটি আমরা কেন করি?

লেখক, ফটোগ্রাফার ও ওয়েবসাইট ‘সোয়ারের’ প্রতিষ্ঠাতা সানিয়া আলী নিজেও এই বদভ্যাসের শিকার। প্রথমে ভেবেছিলেন, এটির সঙ্গে হয়তো স্থান, কাল বা পরিহিত জুতার ধরনের একটা যোগ আছে; কিন্তু পড়ে দেখেন, তাঁর অনুমান ভুল। তিনি লিখেছেন, ‘বাহ্যিক কোনো কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক না পেলেও আমি মনের অবস্থার সঙ্গে পা নাচানোর সংযোগ পেয়েছি। যেমন ধরুন, অবসাদ, উদ্বেগ, মানসিক চাপ, নিরাপত্তাহীনতা, শারীরিক কোনো ব্যথা কিংবা উৎসাহবোধের সময় স্থির হয়ে বসে থাকাটা খুব কঠিন। তখনই বেশি পা নাচানো হয়।’ এ বিষয়ে আরও নিখুঁতভাবে জানতে একজন মনোরোগ–বিশেষজ্ঞ ও একজন স্নায়ুবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছেন সানিয়া আলী। তাঁর সেই জিজ্ঞাসাবাদ থেকেই আসুন জেনে নেওয়া যাক অবচেতনভাবে পা নাচানোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।

মানসিক চাপ ও উদ্বেগ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৭০ লাখের বেশি বাংলাদেশি হতাশা ও মানসিক উদ্বেগে ভুগছে। জাতীয় রোগনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ২০২১-২২ সালের গবেষণা মোতাবেক, প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। এর পেছনে দায়ী, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ। শরীর ও মস্তিষ্কের এ রকম রোগাক্রান্ত অবস্থার একটি ছোট্ট বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে পা নাচানো। এর মাধ্যমে রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং পেশি থেকে পেশিতে বহমান চিন্তার গতি কিছুটা হলেও স্থির হয়। অতএব, মানসিক চাপ সামাল দেওয়ার এক অভিনব পন্থা হচ্ছে পা নাচানো। ‘এটিকে একধরনের ছোট্ট ব্যায়ামই বলা চলে,’ বলেন মার্কিন মনোরোগ–বিশেষজ্ঞ ও মনোবিশ্লেষক শেরিল কলিন্স। তিনি বলেন, পা নাচানোর মাধ্যমে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব; তাই চিকিৎসকেরাও এটিকে সমর্থন করেন।

পা নাচানোর মাধ্যমে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব
ছবি: পেক্সেলস

মনোনিবেশ করার চেষ্টা

অফিসে কাজের সময় কিংবা স্কুল-কলেজে ক্লাস করার সময় অনেকেই পা নাচান। কারও জন্য অপেক্ষারত অবস্থায়ও মনের অজান্তেই পা ক্রমাগত নড়তে থাকে। বিরক্তিকর হলেও চিকিৎসকদের দাবি, এটি মানসিক চাপমুক্তিতে বেশ কার্যকর। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিঙ্গার লিংক জার্নালে প্রকাশিত শিশুদের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একভাবে একাধারে যেকোনো শারীরিক নড়াচড়ার প্রবণতা মনোযোগের ঘাটতি দূর করতে সক্ষম। কলিন্স বলেন, পা নাচানোর মাধ্যমে একঘেয়েমি বা বিভ্রান্তির মতো মনের নেতিবাচক অনুভূতি থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলা যায়।

অত্যধিক ক্যাফেইন গ্রহণ

এই স্বভাবের পেছনে আরেকটি কারণ হতে পারে আপনার প্রতিদিনের সঙ্গী সোডা বা কফি। ক্লান্তি দূর করে শরীরকে ঝরঝরে করে তুলতে কফির তুলনা নেই। তবে স্নায়ু উদ্দীপক এই পানীয় বেশি পান করলে অস্থিরতা, মনোযোগে সমস্যা, উদ্বেগ ইত্যাদি বৃদ্ধি পেতে পারে এবং এসব মানসিক অবসাদের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে ক্রমাগত পা নাচানো।

মানসিক অবসাদের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে ক্রমাগত পা নাচানো
ছবি: পেক্সেলস

শারীরিক মুক্তির প্রয়োজন

জীবিত মানুষের পক্ষে একদমই নড়াচড়া না করে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা প্রায় অসম্ভব। বেশিক্ষণ না নড়াচড়া করে স্থির হয়ে থাকলে রক্ত চলাচলে সমস্যা হয়, শিরায় টান পড়ে কিংবা নানা জায়গায় ব্যথা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ডা. প্যাট্রিক পোর্টার বলেন, ‘আমরা আসলে পা নাচানোকে শারীরিক মুক্তির অবচেতন উপায় হিসেবে ব্যবহার করছি।’

কখন বুঝবেন এটি গুরুতর

সব পা নাচানো সমান নয়। পোর্টার বলেন, স্বাভাবিক পা নাচানো ও রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম, দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বোঝা জরুরি। রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম একটি স্নায়বিক ব্যাধি, যা চিকিৎসার মাধ্যমে ঠিক করা সম্ভব। পা কাঁপানোর সঙ্গে যদি অস্বস্তি বা ব্যথা হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য।

অভ্যাসটিকে যেভাবে বশে আনবেন

পা নাচানোর এই স্বভাব আপনার আশপাশের অনেকের কাছে বিরক্তিকর ঠেকতে পারে। অনেকে এটিকে স্নায়বিক দুর্বলতা কিংবা অধৈর্যের লক্ষণ হিসেবে দেখেন। এতে ভুল–বোঝাবুঝি হতে পারে, বলেন পোর্টার। কিন্তু এই অভ্যাসের তেমন কোনো ক্ষতিকর দিক নেই। ‘তবে আপনি নিজে যদি এই অভ্যাস নিয়ে বিরক্ত থাকেন, তাহলে কী কী কারণে এটি হচ্ছে, সেগুলো ভেবে নিয়ে বাদ দিতে পারেন। হতে পারে সেটা কম ঘুম, মাত্রাতিরিক্ত কফি পান, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ইত্যাদি। তাতেও যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে একজন থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে পারেন। এ ছাড়া নরম খেলনা বল চেপে হাতের ব্যায়াম করলেও এই বদভ্যাস থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব,’ বলেন পোর্টার।