কেন মিলেনিয়াল ও জেন-জিদের মধ্যে বাড়ছে কলোরেক্টাল ক্যানসার
একসময় মনে করা হতো, কলোরেক্টাল ক্যানসার কেবল বয়স্কদের রোগ। কিন্তু এখন চিত্রটা বদলে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিলেনিয়াল ও জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে এই ক্যানসারের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যেও এখন কোলন ও রেক্টাল ক্যানসার ধরা পড়ছে, যা একসময় ছিল বিরল ঘটনা। পায়ুপথে রক্তপাত, হঠাৎ মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন বা দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ে কেউ কেউ চিকিৎসকের কাছে গেলেও দেরিতে রোগ শনাক্ত হয়। কেন এই ক্যানসার তরুণদের মধ্যে বাড়ছে, কোন উপসর্গগুলো উপেক্ষা করা যাবে না, কীভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব, আর কোন খাবার ঝুঁকি কমায়, তা জেনে রাখুন।
পরিসংখ্যান কী বলে
২০১৯ সালে ২০ শতাংশ কলোরেক্টাল ক্যানসার রোগীর বয়স ছিল ৫৫ বছরের নিচে, ১৯৯৫ সালে এটি ছিল অর্ধেক। ৫০ বছরের নিচের বয়সীদের মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৩ শতাংশ হারে গুরুতর রোগের হার বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ইউএস প্রিভেনটিভ সার্ভিস টাস্ক ফোর্স এবং ইউএস মাল্টিসোসাইটি টাস্ক ফোর্স অন কলোরেক্টাল ক্যানসার ২০২১ সালে নতুনভাবে সুপারিশ করেছে যে অধিকাংশ নাগরিকের ৪৫ বছর বয়সেই কলোরেক্টাল ক্যানসার স্ক্রিনিং শুরু করা উচিত।
১৯৯০ দশকের শেষ দিকে ৫০ বছরের কম বয়সী নারী ও পুরুষদের মধ্যে এটি ছিল ক্যানসারজনিত মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ। কিন্তু আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এখন এই বয়সসীমার পুরুষদের মধ্যে এটি ক্যানসারজনিত মৃত্যুর ১ নম্বর কারণ এবং নারীদের মধ্যে ২ নম্বর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি ক্রমেই বাড়ছে।
কেন বাড়ছে এই রোগ
চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না, ঠিক কোন কারণগুলো এর জন্য দায়ী। তবে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ শনাক্ত হয়েছে—
জীবনযাত্রার ধরন
অতিরিক্ত বসে থাকা, স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান, কম আঁশযুক্ত ও বেশি চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, প্রক্রিয়াজাত খাবার (বিশেষ করে মাংসজাত) বেশি খাওয়া।
পরিবারের ইতিহাস
কারও পরিবারে যদি কোলন বা রেক্টাল ক্যানসার থাকে, তবে তার ঝুঁকি বেশি।
অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ
অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ, যেমন ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (আইবিডি) থাকলে।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা
ইয়েল মেডিসিনের চিকিৎসকেরা বলছেন, লিঞ্চ সিনড্রোম নামের একটি বংশগত রোগ কোলন ক্যানসারের জন্য দায়ী হতে পারে। তবে তরুণদের ক্যানসারের বেশির ভাগই এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। অনেক সময়ই এসব ক্যানসার হঠাৎ কোনো পারিবারিক ইতিহাস ছাড়া হয়ে যাচ্ছে, যাকে বলে ‘স্পোরাডিক’ বা আকস্মিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
তরুণদের কি স্ক্রিনিং দরকার
বর্তমানে কলোরেক্টাল ক্যানসার স্ক্রিনিং ৪৫ বছর বয়স থেকে শুরু করার সুপারিশ দেওয়া হচ্ছে, আগে ছিল ৫০ বছরের পর। তরুণদের জন্য স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক নয়, তবে কিছু নির্দিষ্ট কারণে এটি দরকার হতে পারে। যেমন পরিবারে ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে বা উপসর্গ দেখা দিলে।
উপসর্গগুলোর মধ্যে আছে মলত্যাগের অভ্যাসে হঠাৎ পরিবর্তন, পায়ুপথে রক্তপাত, পাতলা বা ফিতার মতো মল, দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া (দুই সপ্তাহের বেশি) ইত্যাদি। ইয়েল মেডিসিনের কলোরেক্টাল সার্জন ডা. বিক্রম রেড্ডি বলেন, ‘যদি কারও মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন হয় বা পায়ুপথে রক্ত দেখা যায়, এমনকি যদি মনে হয়, এটা হেমোরয়েড এবং তা সেরে না যায়, তাহলে অবশ্যই কোলোনোস্কোপি করিয়ে নিতে হবে।’
কলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে যে ৩টি খাবার
১. দই ও অন্যান্য ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার
সপ্তাহে দুই বা তার বেশিবার দীর্ঘ মেয়াদে দই খাওয়ার সঙ্গে কোলনের ডান পাশে হওয়া প্রক্সিমাল কলোরেক্টাল ক্যানসার কম হওয়ার সম্পর্ক আছে। সুফল মিলবে অনেক দিন ধরে দই খেলে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক ৩০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে কলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি প্রায় ১৭ শতাংশ কমে। তবে আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি সতর্ক করেছে যে দুগ্ধজাত খাবার অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
২. হোল গ্রেইন বা গোটা শস্য
প্রতিদিন প্রায় ৯০ গ্রাম গোটা শস্য খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি ১৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এতে থাকা আঁশ, বি ভিটামিন, ম্যাগনেশিয়াম, রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ ও প্রোবায়োটিক অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো করে।
৩. আঁশযুক্ত খাবার
ফল, সবজি, ডাল, গোটা শস্যে থাকা আঁশ অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে পুষ্টি দেয়, গাট মাইক্রোবায়োম বা উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায় এবং কলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। প্রতিদিন আঁশের পরিমাণে প্রতি ১০ গ্রাম বাড়ালে ঝুঁকি ৭ শতাংশ কমে যায়।
তাহলে করণীয় কী
করণীয় হিসেবে তরুণদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা জরুরি। ধূমপান (ই-সিগারেটসহ) ছেড়ে দিতে হবে, অ্যালকোহল সীমিত করতে হবে, নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। প্রতিদিন অন্তত ২৫ গ্রাম আঁশ, যেমন ফল, সবজি, গোটা শস্য, ডাল ও ছোলা খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। এর পাশাপাশি উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করা দরকার। যদি চিকিৎসায় সন্তুষ্ট না হন, তবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় মতামত নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। পরিবারের কারও কলোরেক্টাল ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে ৪৫ বছরের আগেই কোলোনোস্কোপি করানো উচিত।
সবশেষে
কলোরেক্টাল ক্যানসার এখন শুধু প্রবীণদের সমস্যা নয়। মিলেনিয়াল ও জেন-জি প্রজন্মের তরুণেরাও এর ঝুঁকিতে আছেন। সতর্কতা, সচেতনতা এবং সময়মতো পদক্ষেপ—এই তিনেই মিলতে পারে সুরক্ষা।
সূত্র: ইয়েল মেডিসিন ও ফরচুন ডটকম