হোয়াটসঅ্যাপের সেই ভিডিওতে দেখি, আমার রোগী নাচছেন

চার দশকের বেশি সময় ধরে থাইল্যান্ডে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন ডা. শক্তিরঞ্জন পাল। তার মধ্যে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংকক হাসপাতালে কর্মরত আছেন এই বাংলাদেশি চিকিৎসক। সম্প্রতি অল্প সময়ের জন্য এসেছিলেন ঢাকায়। এক ফাঁকে অভিজ্ঞ এই চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জিনাত শারমিন

ডা. শক্তিরঞ্জন পাল
ছবি: সংগৃহীত

ধন্যবাদ এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য। ছোটবেলা থেকে শুরু করি। সব সময় কি চিকিৎসকই হতে চেয়েছিলেন?
আপনাকেও ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আমি নোয়াখালীর ছেলে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করে কিছুদিন সরকারি চাকরি করি। তারপর পিজিতে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) পড়াশোনা করতে করতেই থাইল্যান্ডে একটা ভালো চাকরির সুযোগ হয়। ১৯৮১ সাল থেকে ইউনাইটেড নেশনসের এইডস প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ২০০০ সাল থেকে যুক্ত হই ব্যাংকক হাসপাতালের সঙ্গে। এখনো সেখানে আছি। বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন কাজ নিয়ে আসা হয়।
ব্যাংকক হাসপাতালে আপনি কী নিয়ে কাজ করছেন?
আনডায়াগনজড ইলনেস নিয়ে। মানে অনির্ণেয় রোগ। মনে করুন, একজন রোগী দীর্ঘ সময় ধরে নানা উপসর্গ নিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর রোগ ধরা যাচ্ছে না। ব্যাংকক হাসপাতালে এ রকম অনেক বাংলাদেশি রোগী আসেন। দীর্ঘ সময় ধরে জ্বর, ওজন কমে যাওয়া, খেতে না পারা, শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে অস্বাভাবিক ব্যথা, তীব্র শ্বাসকষ্ট, হার্টে ব্যথা, পেটে ব্যথা, আমাশয়—এ রকম সব উপসর্গ থাকে।

কয়েকটা কেস স্টাডির কথা বলতে পারেন?
৫৬ বছর বয়সী একজন নারী। ৬ মাসে ২৩ কেজি ওজন কমে গিয়েছিল। ঢাকাতে তিনটা হাসপাতালে ভর্তি থেকে নানা ডায়াগনোসিস করিয়েছেন। কিছুই ধরা পড়েনি। শেষে যখন ব্যাংকক হাসপাতালে আসেন, অবস্থা খুবই খারাপ। শ্বাস নিতে পারেন না। আইসিইউতে। আমি রিপোর্টগুলো দেখলাম, সব মোটামুটি ঠিক ছিল। আমরা তখন একটা মডার্ন স্ক্রিনিং টেস্ট করালাম, দেখা গেল এইডস পজিটিভ। আমি আগেই রোগী বা তাঁর আত্মীয়স্বজনকে না জানিয়ে অ্যাডভান্সড আরেকটা টেস্ট করলাম, এবার একদম নিশ্চিত হয়ে গেলাম। ফুসফুসে নিউমোনিয়া, শরীরে ম্যাগনেশিয়াম খুবই কম—২৪ ঘণ্টার ভেতরে চিকিৎসা শুরু হলো। পরের ২৪ ঘণ্টার ভেতর তিনি আইসিইউ থেকে বের হয়ে গেলেন। কয়েক দিনের ভেতর সুচিকিৎসায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর স্বামীরও এইডস টেস্ট করা হলো। নেগেটিভ। সেই নারীর এইডসের তেমন কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। সাত বছর আগে তিনি একবার রক্ত নিয়েছিলেন। সেখান থেকে হতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি।
দ্বিতীয় যে কেস স্টাডির কথা বলব, তিনিও একজন নারী। বাংলাদেশি আমেরিকান, বয়স ৩৯ বছর, ২ সন্তানের মা। তিন বছর ধরে প্রচণ্ড ব্যাকপেইন। যুক্তরাষ্ট্রেই ডাক্তার দেখিয়েছেন। ফিজিওথেরাপি নিয়েছেন। স্পাইন–বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো সার্জারিও করান। সার্জারির পর ব্যথা আরও বাড়ে। পুরোপুরি হুইলচেয়ারে চলে যান। এ রকম অবস্থায় তাঁর হাজবেন্ডের সঙ্গে একধরনের সেপারেশন হয়ে যায়। বাচ্চারা ওখানে স্কুলে পড়ছিল। বাবার সঙ্গেই থাকবে বলে ঠিক হলো। তিনি ওই অবস্থায় দেশে চলে আসেন। প্রচণ্ড ব্যথার সঙ্গে ভীষণ ডিপ্রেশনে পড়ে যান। তাঁর মা আবার আমার পূর্বপরিচিত। মা মেয়েকে দুই ভাগনির সঙ্গে থাইল্যান্ড পাঠিয়ে দেন। আমরা পরীক্ষা করে দেখি, ফাইব্রোমায়ালজিয়া। এই রোগ কেন হয়, নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা যায় না। নারীদের বেশি হয়। দুশ্চিন্তা, স্ট্রেসফুল জীবনযাপন, ব্যায়াম না করা, টিভি, মোবাইল, কম্পিউটারে বেশি সময় কাটানোর সঙ্গে রোগটির সম্পর্ক আছে। এমনকি ডিপ্রেশন থেকেও এটা হতে পারে। আমি তাঁকে বললাম যে আপনার রোগটা সেরে যেতে পারে, সম্ভাবনা আছে, তবে সময় লাগবে। ধৈর্য ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে অন্তত মাসখানেক। রোগী উচ্চশিক্ষিত, খুবই স্মার্ট। তিনি এমন ব্যথা নিয়ে এসেছিলেন যে শরীরের কোথাও স্পর্শও করতে দিচ্ছিলেন না। আমি প্রথমে তাঁকে কিছু পেইন কিলার দিলাম, যেগুলো কিডনির কোনো ক্ষতি করে না। আর দিলাম অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট। তারপর শুরু হলো হাইড্রো থেরাপি। ছোট একটা সুইমিংপুলের ভেতর নির্দিষ্ট মাত্রায় ওয়াটারফোর্স দিয়ে মাসলকে ভাইব্রেট করা হয়। তিনি খুবই ভালোভাবে রেসপন্ড করলেন। তিন সপ্তাহের ভেতর হাঁটা শুরু করলেন। ছয় সপ্তাহ ছিলেন। এরপর তাঁর মা বললেন যে আমি যেন তাঁর স্বামীর সঙ্গে তাঁকে এক করে দিই। আমি তাঁর স্বামীকে ফোন করলাম। তিনি তো বিশ্বাসই করেন না। ভিডিও কলে দেখালাম। রোগী বেশ কয়েকবার মডেলের মতো করে হেঁটে দেখালেন। তিনি তবু ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। রোগী বাংলাদেশে ফিরে গেলেন। এরপর রোগীর এক ভাগনি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভিডিও পাঠালেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, আমার সেই রোগী আর তাঁর স্বামী বাংলাদেশে একটা বিয়েবাড়িতে নাচছেন!
এ রকম ‘আনডায়াগনোজড ইলনেসের’ ক্ষেত্রে আপনাদের সফলতার হার কেমন?
প্রায় ৯০ ভাগ। পাঁচ ভাগ ক্ষেত্রে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হন না। আর পাঁচ ভাগ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় করা যায় না।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে বাড়ছে। এ ব্যাপারে আপনার কী মতামত?
আপাতত স্প্রে করে কমাতে হবে। তবে জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা দরকার। বিচ্ছিন্নভাবে হবে না। আর ব্যক্তিপর্যায় থেকে বলব, মসকুইটো রেপেলেন্ট ব্যবহার করতে। অনেক ক্রিম, লোশন অরগানিক উপাদানে বানানো। বিশেষ করে বাচ্চাদের খোলা জায়গায় লাগাতে হবে। এগুলো দুই থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত কার্যকর থাকে। লোশনটা সব সময় সঙ্গে রাখবেন। রেস্টুরেন্টে গেলেন বা ঘুরতে গেলেন, লাগিয়ে নিলেন।
শেষ প্রশ্ন। আপনি তো দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিবর্তন দেখছেন। আপনার দুটি পর্যবেক্ষণ যদি বলেন।
চিকিৎসকের সংখ্যা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। ফলে যাঁরা আছেন, তাঁদের ওপর অনেক চাপ পড়ে। দিনে একজন বিশেষজ্ঞের যেখানে ১০ থেকে ১৫ জন রোগী দেখার কথা, তাঁকে হয়তো দেখতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ জন। এর ফলে কোয়ালিটি ড্রপ করতে পারে। আর দ্বিতীয়ত, চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নলেজ যুক্ত হচ্ছে। সেটার সঙ্গে নিজেকে হালনাগাদ করে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমার বয়স ৬৯, আমি প্রতি সপ্তাহে সেমিনার, ওয়েবিনারে যুক্ত হই। যদিও এটা যথেষ্ট নয়।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন